শিশুকন্যার টার্নার সিনড্রোম ও চিকিৎসা

Dr. Swati Mishra
Dr. Swati Mishra

MBBS, MS (Obstetrics & Gynaecology)

20+ Years of experience
শিশুকন্যার টার্নার সিনড্রোম ও চিকিৎসা

কোনও কারণে শিশুকন্যার উচ্চতা যদি বয়সের সঙ্গে না বাড়ে এবং স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধির হার অনেকটা কম মনে হয়, তাহলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে এর সঙ্গে যদি ছোট থুতনি ও লুপ্তপ্রায় ঘাড়, ছোট কান, চোখের সমস্যা ইত্যাদি অনুষঙ্গ দেখা যায়, তাহলে অতিঅবশ্য চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া দরকার। কারণ, হতে পারে শিশুকন্যাটি টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত। সমস্যাটি জিনগত দুর্ঘটনার ফল এবং জন্মগত অর্থাৎ জন্ম থেকেই বহন করে শরীর। এই সিনড্রোমে আক্রান্তদের যৌনজীবনের বিকাশ ঠিকমতো হয় না বলে সন্তানধারণে অক্ষমতার সমস্যা দেখা দেয়। মুশকিল হল, জিনগত এই দুর্ঘটনাটি রোধ করা বা আটকানো বা সম্পূর্ণ নিরাময়ের কোনও উপায় নেই। তবে অনুসারী সমস্যা বা উপসর্গের মোকাবিলা করার জন্য হরমোন থেরাপি-সহ নানা চিকিৎসা রয়েছে। যত দ্রুত সেই চিকিৎসা শুরু করা হবে তত ভাল ফল পাওয়া যাবে।

টার্নার সিনড্রোম কী

দু’টো সেক্স ক্রোমোজোম নিয়ে আমরা সকলে জন্মগ্রহণ করি। ছেলে হলে একটি এক্স ও একটি ওয়াই ক্রোমোজোম এবং মেয়ে হলে দু’টি এক্স ক্রোমোজোম থাকে। এখন দু’টি এক্স ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি যদি আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে অনুপস্থিত থাকে, তখন টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত হন শিশুকন্যাটি। স্বাভাবিক ৪৬টির বদলে এক্ষেত্রে ৪৫টি ক্রোমোজোম থাকে (৪৫ এক্স বা ৪৫ এক্সজিরো)। টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যহত হয়। বুদ্ধিমত্তায় অসুবিধা না হলেও অঙ্ক বা হিসাব কষা ও স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা হয়। আক্রান্তদের যৌনঅঙ্গ ও প্রজননতন্ত্র ঠিকমতো গড়ে ওঠে না। ফলে মাসিক ঋতুস্রাব হয় না বা শুরু হতে দেরি হয় এবং সন্তানধারণে সমস্যা হয়। হার্টের অসুখ থেকে শুরু করে থাইরয়েড, ডায়াবেটিস-সহ নানা রোগ আসে অনুসারী হয়ে। যে কারণে টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তদের আয়ু তুলনায় কম হয়ে থাকে। ১৯৩৮ সালে আমেরিকান এন্ডোক্রিনোলজিস্ট হেনরি টার্নার প্রথম এই প্রবণতাটি চিহ্নিত করেন এবং ১৯৬৪ সালে এর কারণ হিসাবে ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকত্বকে দায়ী করা হয়।

টার্নার সিনড্রোমের প্রকারভেদ

এক্স ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতি সম্পূর্ণ না আংশিক, তার উপরে নির্ভর করে টার্নার সিনড্রোমের বহিঃপ্রকাশ কতটা হবে।

১) মোনোজ়োমি- শরীরের সমস্ত কোষেই যখন দু’টির বদলে একটি এক্স ক্রোমোজোম থাকে, তখন তাকে বলে মোনোজ়োমি এক্স। টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় প্রায় ৪৫ শতাংশ এই প্রকারের মধ্যে পড়ে। মায়ের ডিম বা বাবার শুক্রাণুর কোনও একটিতে এক্স ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতি থেকে এটা হয়। নিষিক্তকরণের পর ভ্রূণেও যে সমস্যাটি রয়ে যায়। মোনোজ়োমিতে অস্বাভাবিকত্বের বহিঃপ্রকাশ অনেক বেশি হয়।

২) মোজাইক টার্নার সিনড্রোম- এক্ষেত্রে শিশুর কিছু কোষে দু’টি এক্স ক্রোমোজোম থাকে এবং কিছুতে একটা এক্স থাকে। গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে কোষ বিভাজনের সময় এই দুর্ঘটনাটি হয়। ৩০ শতাংশ টার্নার সিনড্রোম এই প্রকৃতির হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ তুলনায় কম হয় ও কিছু ক্ষেত্রে তেমন কোনও লক্ষ্মণ বোঝাও যায় না বাইরে থেকে।

৩) ইনহেরিটেড টার্নার সিনড্রোম- খুব কম হলেও অনেক সময় এই জেনেটিক ত্রুটি মা-বাবার থেকে সন্তানের মধ্যে আসে। একটি এক্স ক্রোমোজোমের কিছু অংশ হারিয়ে গিয়ে এই অবস্থা হয়।

৪) ওয়াই ক্রোমোজোম মেটেরিয়াল- বিরল আর একটি প্রকারভেদ হল কিছু কোষে একটি এক্স ক্রোমোজোম এবং কিছু কোষে একটি এক্স ক্রোমোজোমের সাথে ওয়াই ক্রোমোজোমের কিছু উপাদান চলে আসা। এক্ষেত্রে শিশুটি কন্যাসন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও ওয়াই ক্রোমোজোম মেটেরিয়ালের জন্য গোনাডোব্লাস্টোমা নামে এক ধরনের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে পরবর্তীকালে।

টার্নার সিনড্রোমের বৈশিষ্ট্য বা লক্ষ্মণ

টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তদের লক্ষ্মণগুলি ছোটবেলা থেকেই একে একে পরিস্ফূট হতে থাকে। এমনকী গর্ভাবস্থাতেও কিছু লক্ষ্মণ থেকে এই সমস্যাটি চিহ্নিত করা যায়। ঘাড়ের কাছে জমে থাকা ফ্লুইড, কিডনি ও হার্টের অস্বাভাবিকত্ব গর্ভাবস্থার আলট্রাসাউন্ডে সামনে আসা উচিত। বাচ্চা জন্মানোর সময়ে তুলনায় ছোট আকার, হাত পায়ে ফোলা ভাব-সহ কিছু লক্ষ্মণ নজরে আসে। এরপর বাচ্চা বড় হতে শুরু করলে একে একে অনেকগুলো লক্ষ্মণই সামনে আসে।

১) প্রথম ও প্রধান লক্ষ্মণ হল কম উচ্চতা বা আশানুরূপ শারীরিক বৃদ্ধি না হওয়া।

২) শুধু উচ্চতাই নয়, সামগ্রিক গড়নেও অস্বাভাবিকত্ব ফুটে ওঠে সময়ের সঙ্গে। যেমন, ছোট থুতনি, ক্ষুদ্রাকৃতি বা লুপ্তপ্রায় ঘাড়, পেছন দিকের চুলের রেখা নীচে পিঠ পর্যন্ত নেমে আসা, হাতের কোণ বেড়ে যাওয়া, চোখ পিটপিট করা, একটা চোখ অকার্যকর (লেজি আই), দাঁতের সমস্যা, শরীরে নানা জায়গায় আঁচিল বা তিল, হাত ও পায়ের ছোট নখ, শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়া ইত্যাদি।

৩) বয়স বাড়ার সাথে সাথে যে লক্ষ্মণটি চিন্তা বাড়ায়, সেটি হল হল যৌনজীবন বিকশিত না হওয়া। টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তদের ঢালের মতো বুকের গড়ন হয় ও স্তনযুগলের দূরত্ব বেশি থাকে। বয়সের সঙ্গে স্তনের আকার বাড়ে না। মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হতে দেরি হয় বা হয়ই না। অনেকের আবার সময়ের আগে ঋতুচক্র শেষ হয়ে যায়। ডিম্বাশয়ের আকার ছোট হয় এবং অনেকসময়ই তার কার্যকারিতা থাকে না। সেক্স হরমোন ঠিকমতো নিঃসরণ হয় না।

৪) প্রজননতন্ত্রের গঠনে ত্রুটি থাকে বলে টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তদের সন্তানধারণে অক্ষমতা হল সবচেয়ে বড় সমস্যা।

৫) জিনগত ত্রুটির কারণে টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তদের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠনে সমস্যা থাকে। যা থেকে নানা ধরনের অসুখ হয়। যেমন, টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের হার্টের গড়নে সমস্যা থাকে। উচ্চ রক্তচাপ, হাই কোলেস্টেরল, হাই ট্রাইগ্লিসারাইড, টাইপ টু ডায়েবেটিস থেকে শুরু করে হাইপারটেনশন, ইনস্যুলিন রেজ়িস্ট্যান্ট, মোটা হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো চেপে ধরে বয়স বাড়লে। দুর্বল হাড়ের সমস্যা থেকে মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়া (স্কলিওসিস, কাইফোসিস), অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি থাকে। এছাড়াও হাইপোথাইরয়েডিজ়ম, পরিপাকতন্ত্রে সমস্যা, কিডনি ইনফেকশন ইত্যাদিতে ভুগতে হয়। কানের গঠনে সমস্যা থাকে বলে ঘন ঘন কান পাকে (মিডল ইয়ার ইনফেকশন) অনেকের। এমনকী ‘সেনসরিনিউরাল হিয়ারিং লসে’র মতো সমস্যাও হয় বয়সকালে।

৫) টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তদের সাধারণত কাছের দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা বেশি হয়। কালার ব্লাইন্ডনেসও হতে পারে।

৬) শারীরিক গঠনে অস্বাভাবিকত্ব এবং সন্তানধারণের অক্ষমতার সমস্যা থেকে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা আসে। আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় ভোগা যার মধ্যে অন্যতম। এই সিনড্রোমে আক্রান্তদের অনেকের মধ্যে এডিএইচডি (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজ়অর্ডার) উপসর্গ দেখা যায়।

টার্নার সিনড্রোম নির্ণয়

জন্মের আগেই গর্ভাবস্থায় কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে জিনগত এই ত্রুটি ধরা পড়তে পারে। মায়ের রক্ত নিয়ে ম্যাটারনাল সিরাম স্ক্রিনিং করে দেখা যেতে পারে সন্তানের ক্রোমোজোমের গঠনে ত্রুটি রয়েছে কি না। এছাড়া প্ল্যাসেন্টা (কোরোনিক ভিলাস স্যাম্পলিং) বা অ্যামনিওটিক ফ্লুইড (অ্যামনিওসেনটেসিস) থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তার জেনেটিক পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় সন্তানের টার্নার সিনড্রোম আছে কি না। গর্ভাবস্থায় প্রসূতির যখন আলট্রাসাউন্ড করা হয় তখন শিশুর কিডনি, হার্টের সমস্যা বা ঘাড়ের কাছে ফ্লুইড দেখে চিকিৎসকেরা আন্দাজ করতে পারেন এই জেনেটিক ত্রুটি। টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর জন্মের পরে এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই বাহ্যিক বেশ কিছু লক্ষ্মণ বাবা-মা ও আত্মীয় পরিজনদের নজরে আসে। তখন চিকিৎসকের দ্বারস্থ হলে জেনেটিক পরীক্ষা ক্যারিওটাইপ অ্যানালাইসিস করতে দেওয়া হয়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এটি সম্পন্ন হয় যাতে বোঝা যায় ক্রোমোজোমে কোনও ত্রুটি রয়েছে কি না। এছাড়া এই জেনেটিক ত্রুটির অনুসারী শরীরের অন্যান্য সমস্যাগুলি নির্ধারণের জন্য কিডনির আলট্রাসোনোগ্রাম, ইকোকার্ডিওগ্রাম, গোনাডোট্রাপিন ও সেক্স হরমোনের উপস্থিতির পরীক্ষা এবং জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের আলট্রাসোনোগ্রাম করা হয়।

টার্নার সিনড্রোমের চিকিৎসা

কন্যাসন্তানের টার্নার সিনড্রোম নির্ণয় হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া দরকার।
১) ইনজেকশনে হিউম্যান গ্রোথ হরমোন প্রয়োগ করলে উচ্চতা বাড়ে। অল্প বয়সেই এই চিকিৎসা শুরু হয়ে গেলে বেশ কয়েক ইঞ্চি উচ্চতা বাড়তে পারে।

২) ইস্ট্রোজেন অর্থাৎ নারী হরমোন প্রতিস্থাপন করে টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তের স্তনের বিকাশ বা মাসিক ঋতুস্রাব শুরু করা সম্ভব। জরায়ুর আকার বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে এই হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি। এমনকী ব্রেনের বিকাশ থেকে শুরু করে হার্ট, লিভার ইত্যাদির কার্যকারিতাও বাড়ায় ইস্ট্রোজেন।

৩) ১১ থেকে ১২ বছর বয়সে প্রয়োজনে প্রোজেস্টিন প্রয়োগ করা হয় ঋতুস্রাব নিয়মিতকরণে। তবে খুব কম মাত্রাতেই এটি দেওয়া হয় এবং পরে ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়ানো হয়।

এককথায় বলা যেতে পারে, টার্নার সিনড্রোম জন্মগত একটি দুর্ঘটনা যেটির উপরে বাবা-মা কিংবা সন্তানের কারও কোনও হাত নেই। এটিকে রোধ করা বা আটকানোর কোনও উপায় নেই। তবে হরমোন থেরাপি-সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করে এই জেনেটিক ত্রুটির উপসর্গগুলিকে অনেকটাই মোকাবিলা করা যায় ও সুস্থ জীবন বাঁচা যায়।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা

১) টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত মহিলা কি গর্ভবতী হতে পারেন?

সাধারণত টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্তেরা সন্তানধারণে অক্ষম বা অনুর্বর হন। তবে, উর্বরতা বৃদ্ধির প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে কেউ কেউ সন্তানধারণে সক্ষম হন। খুব কম ক্ষেত্রে বাইরে থেকে কোনও সাহায্য না নিয়ে সন্তানধারণ সম্ভব হয়।

২) টার্নার সিনড্রোমে কি ছেলেরা আক্রান্ত হতে পারে?

না, কেবল মেয়েদেরই এই সমস্যা হয়। কারণ সমস্যাটি আসে এক্স ক্রোমোজোম থেকে।

৩) সন্তান টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত হলে কী ভাবে তার মোকাবিলা করা উচিত?

দ্রুত সমস্যাটিকে চিহ্নিত করা দরকার এবং শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া দরকার। গ্রোথ হরমোন বা ইস্ট্রোজেন প্রয়োগ সময়ে শুরু হলে অনেক সমস্যা এড়ানো যায়। তবে, শুধু শিশু বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হলে চলবে না, কার্ডিওলজিস্ট, অপথ্যালমোলজিস্ট, ইএনটি স্পেশালিস্ট থেকে শুরু করে সাইকোলজিস্টের সঙ্গেও পরামর্শ দরকার।

Our Fertility Specialists

Related Blogs