সারোগেসি-র মাধ্যমে সন্তান-সুখ
- Published on March 23, 2023

২০০২ সালে ‘ফিলহাল’ নামে একটি হিন্দি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল, যেখানে সুস্মিতা সেন ‘সারোগেট’ মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই সময় সারোগেসি বিষয়টির সঙ্গে ততটা পরিচয় ছিল না আমজনতার। তাই মেঘনা গুলজার পরিচালিত ও সঞ্জয় সুরী, তাব্বু, সুস্মিতা সেন, পলাশ সেন অভিনীত এই সিনেমাটি দর্শকমহলে একদিকে যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েও বক্স অফিসে সেভাবে ‘হিট’ হতে পারেনি। এর প্রায় কুড়ি বছর পর ২০২১ সালে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এই একই বিষয়ের উপর নির্মিত হিন্দি সিনেমা ‘মিমি’কে অবশ্য ‘অজানা-অচেনা’ বিষয় বলে কোনও সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি। কারণ শাহরুখ-গৌরি খানের ছেলে আব্রাম থেকে করণ জোহরের যমজ আর হালে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া-নিক জোনাসের কন্যাসন্তানের সুবাদে সারোগেসি শব্দটি বহুল প্রচলিত ততদিনে।
Table of Contents
সারোগেসি কাকে বলে?
সারোগেসির অর্থ হল, অন্যের সন্তানকে গর্ভে ধারণ, চলিত কথায় গর্ভ ভাড়া। সারোগেসি হল এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে আইনি সম্মতিতে একজন নারী তাঁর গর্ভে অন্য দম্পতির সন্তান ধারণ করেন ও জন্ম দেন।
শারীরিক সমস্যার কারণে কোনও মহিলা গর্ভধারণ করতে না পারলে বা বারবার গর্ভপাত হলে অন্য মহিলার গর্ভে সন্তান পালন করা যেতে পারে। এটা দু’ভাবে হয়-
১) জেসটেশানাল সারোগেট– এক্ষেত্রে সারোগেট মায়ের জরায়ুতে আইভিএফ (ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) পদ্ধতিতে সরাসরি ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা হয়। ভ্রূণ তৈরির জন্য ল্যাবরেটরিতে যে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ব্যবহার করা হয় তা হবু বাবা-মা’র নিজস্ব হতে পারে বা অন্য দাতার কাছ থেকে সংগৃহীত হতে পারে। সারোগেট মা বা গর্ভদাত্রী শুধুমাত্র তাঁর গর্ভে সন্তানকে বড় করেন, ‘বায়োলজিক্যাল’ মা হন না। সন্তানের সঙ্গে সারোগেট মায়ের কোনও জিনগত যোগাযোগ থাকে না। তিনি শুধুমাত্র জন্মদাত্রী মা (বার্থ মাদার)।
২) ট্র্যাডিশনাল সারোগেট– এই ক্ষেত্রে যাঁর গর্ভে সন্তান বড় হবে, তাঁরই ডিম্বাণুতে ভ্রূণের সৃষ্টি হয়। আইইউআই (ইন্ট্রাইউটেরাইন ইনসেমিনেশন) পদ্ধতিতে শুক্রাণু (হবু বাবার হতে পারে বা দাতার থেকে সংগৃহীতও হতে পারে) সারোগেট মায়ের গর্ভাশয়ে প্রবেশ করিয়ে গর্ভধারণ সম্পন্ন হয়। এই পদ্ধতিতে তুলনায় খরচ কম এবং জটিলতা কম হওয়া সত্ত্বেও জেসটেশানাল সারোগেসিই বেশি প্রচলিত। কারণ, ট্র্যাডিশানাল পদ্ধতিতে গর্ভদাত্রী মা একই সঙ্গে সন্তানের ‘বায়োলজিক্যাল’ মা-ও হন বলে পরবর্তী কালে নানা ধরণের সামাজিক, আইনি ও মানসিক জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ভারতে সারোগেসি
‘ফিলহাল’ হোক বা ‘মিমি’, আজকের দিনে তৈরি হলে দু’টো সিনেমাকেই অন্য ভাবে বানাতে হত। কারণ, ‘দ্য অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলজি অ্যান্ড সারোগেসি অ্যাক্ট, ২০২১’ অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে সন্তানধারণ অর্থাৎ ‘কমার্শিয়াল সারোগেসি’ ভারতে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। নতুন এই আইনে শুধুমাত্র ‘অলট্রুয়িস্টিক সারোগেসি’ বা সেবার মনোভাব নিয়ে গর্ভে অন্যের সন্তানধারণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং শুধুমাত্র নিঃসন্তান দম্পতির নিকট আত্মীয়কে সারোগেট মা হওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। ‘ফিলহাল’ সিনেমায় বন্ধুর সন্তানকে যে ভাবে গর্ভে ধারণ করেছিলেন সুস্মিতা সেন, আজকের আইনে তা নিষিদ্ধ। আর ‘মিমি’র বিষয় কমার্শিয়াল সারোগেসি আজকের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। বস্তুত ‘মিমি’তে যা দেখানো হয়েছে, টাকার টোপ দেখিয়ে সারোগেসিতে রাজি করানো বা মাঝপথে গর্ভদাত্রী মাকে ফেলে বিদেশি দম্পতির চলে যাওয়া ইত্যাদি অন্যায়-অবিচারগুলো রুখতেই নয়া আইন নিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক। সারোগেসিতে কোনও রকম আর্থিক লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়েছে। শুধুমাত্র গর্ভদাত্রীর চিকিৎসার খরচ দেবেন হবু বাবা-মা। অনিয়ম হলে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং পাঁচ বছরের জেল হতে পারে। এক বারের বেশি এই অনিয়ম করলে দশ বছর পর্যন্তও জেল হতে পারে।
সারোগেসি কাদের জন্য?
অনেক সময় মহিলার সুস্থ ডিম্বাণু থাকলেও জরায়ুর কোনও সমস্যার কারণে গর্ভধারণ সম্ভব হয় না বা বারবার গর্ভপাত হয়ে যায়। আবার অনেকসময় পূর্বে জরায়ু বাদ (হিস্টেরেক্টোমির ক্ষেত্রে) দেওয়ার কারণে গর্ভধারণ সম্ভবপর হয় না। কখনও আবার গর্ভধারণের সঙ্গে অন্যান্য শারীরিক সমস্যা জড়িত থাকায় (যেমন হার্টের সমস্যা) সন্তানধারণ সম্ভব হয় না। এই সমস্ত শারীরিক প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে অন্য মহিলার গর্ভে নিজের সন্তানকে পালন করা যায় সারোগেসির মাধ্যমে। এছাড়া সমকামী দম্পতি (পুরুষ) ও সিঙ্গল পেরেন্টরাও (পুরুষ) অন্য মহিলার গর্ভ ভাড়া নিয়ে সন্তানলাভ করতে পারেন। যে ভাবে সারোগেসির সাহায্য নিয়ে বাবা হয়েছেন অভিনেতা তুষার কাপুর, চিত্র পরিচালক করণ জোহররা। কিন্তু আফশোসের বিষয় হল, ভারতে এই ধরনের সুযোগ আর থাকছে না নয়া ব্যবস্থায়।
শুধুমাত্র আইনি বিয়ের পর পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে এমন দম্পতিই (এদেশের নাগরিক হতে হবে) সারোগেসির সাহায্য নিতে পারবে নতুন আইনে। বিবাহিত দম্পতি ছাড়া অন্য কেউ, অর্থাৎ সমকামী বা লিভ ইন রিলেশনশিপে থাকা যুগলেরা এর সাহায্য নিতে পারবে না। সিঙ্গল বাবা বা মায়েরাও সারোগেসির সুযোগ নিতে পারবে না। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে সন্তানধারণে অক্ষমতা সংক্রান্ত সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে সারোগেসি নিতে ইচ্ছুক দম্পতিকে।
আবেদনকারী দম্পতির মধ্যে মহিলার বয়স ২৩-৫০ এবং পুরুষের বয়স ২৬-৫৫ বছর হতে হবে। দম্পতির কোনও সন্তান থাকলে সারোগেসির সাহায্য নেওয়া যাবে না। সেই সন্তান যদি প্রথম পক্ষের হয় বা দত্তক নেওয়া হয়, তা হলেও সারোগেসি করা যাবে না।
সারোগেট মা কে হতে পারেন?
নতুন আইনে সারোগেট মা বা গর্ভদাত্রী কে হতে পারবেন তা নিয়েও সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। প্রথমত, দম্পতির নিকটাত্মীয় ছাড়া বাইরের কেউ সারোগেট মা হতে পারবেন না। গর্ভদাত্রী সন্তানধারণের উপযুক্ত কি না তার শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে। অন্ততপক্ষে একটি সুস্থ সন্তান থাকতে হবে সারোগেট মায়ের। জীবনে একবারই সারোগেট মা হওয়া যাবে, তার বেশি নয়।
পশ্চিমবঙ্গে সারোগেসি নির্দেশিকা
২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার সারোগেসি নিয়ে নিজস্ব যে নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে তাতেও কেন্দ্রের শর্তগুলিই জারি রযেছে। এই রাজ্যে নিঃসন্তান দম্পতিকে সন্তানধারণে অক্ষমতার শংসাপত্র জেলা স্তরের সরকারি (সারোগেসি বিষয়ক) মেডিক্যাল বোর্ডের কাছ থেকে নিতে হবে। এতে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে রাজ্য স্তরের ‘সারোগেসি অ্যাপ্রেপ্রিয়েট অথরিটি’। সারোগেট’ মাকেও ‘ফিট সার্টিফিকেট’ জমা দিতে হবে। তাঁর তিন বছরের স্বাস্থ্যবিমার দ্বায়িত্ব নিতে হবে গর্ভ ভাড়ায় ইচ্ছুক দম্পতিকে।
সারোগেসি পদ্ধতি
১) সন্তানধারণে অক্ষমতার শংসাপত্র জোগাড় ও সারোগেসির আবেদন।
২) সারোগেট মা খোঁজার পর তাঁর শারীরিক পরীক্ষা। সিফিলিস, গনোরিয়া, এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি, সি-র মতো রোগগুলি রয়েছে কি না এবং রুবেলা, চিকেন পক্স এর মতো রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা রয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া হয়। অনেক জায়গায় সারোগেট মায়ের ‘মেন্টাল কাউন্সেলিং’ করা হয়।
৩) আইনি চুক্তির কাজ সেরে ফেলতে হবে আগেই। সারোগেসি সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে আবেদনের ফর্ম ও চুক্তিপত্রে অনেক শর্ত রাখা হচ্ছে নতুন আইনে। সন্তানধারণের মধ্যে বা জন্মের পরে বাবা-মা দু’জনে মারা গেলে বা বিবাহবিচ্ছেদ হলে সন্তানের দায়িত্ব কে নেবে, তা জানাতে হচ্ছে ফর্মে। আইনি মা এবং সারোগেট মায়ের পরিচয়ের রেকর্ড জন্মের পর ২৫ বছর পর্যন্ত রেখে দিতে হবে। সম্পত্তি-সহ সব রকমের অধিকার যাতে পায় সন্তান, তা নিশ্চিত করা হবে আইনি চুক্তিতে।
৪) জেসটেশানালের ক্ষেত্রে আইভিএফ ও ট্রাডিশনাল সারোগেসিতে আইইউআই পদ্ধতিতে সন্তানধারণ সম্পন্ন হওয়ার পর গর্ভাবস্থার চিকিৎসা চলে ধাপে ধাপে।
৫) সন্তানের জন্মের পর পুরোপুরি ‘লিগাল কাস্টোডি’ পাবে দম্পতি।
সারোগেসির খরচ
সহায়ক গর্ভধান বিশেষ করে আইভিএফ পদ্ধতিতে মূলত সারোগেসি করা হয়। তাই আইভিএফ-এ যেমন খরচ হয়, সেটা হবে। আইইউআই পদ্ধতিতে খরচ তুলনায় কম। চিকিৎসার খরচ ছাড়াও স্বাস্থ্যবিমা এবং আইনি কাজে খরচ আছে।
আগে এই খরচাগুলো ছাড়াও গর্ভ ভাড়া নেওয়ার জন্য (কমার্শিয়াল সারোগেসি) গর্ভদাত্রী, এজেন্টদের টাকা দিতে হত। তাতে কোনও মাত্রা ছিল না। সাধারণ ভাবে ৫-৬ লক্ষ টাকা নিতেন গর্ভদাত্রীরা। এছাড়া কমিশন বাবদ মোটা টাকা নিত এজেন্টরা। সব মিলিয়ে ১০ থেকে ৩৫ লক্ষ পর্যন্ত খরচ হয়ে যেত। কিন্তু নয়া আইনে কমার্শিয়াল সারোগেসি বন্ধ। শুধুমাত্র চিকিৎসা ছাড়া অন্য কোনও খাতে খরচ করতে পারবে না দম্পতি। গর্ভ ভাড়া দেওয়ার জন্য টাকা নিতে পারবেন না গর্ভদাত্রী বা তাঁর এজেন্ট। তবে, আইনের ফাঁক গলে এখনও কমার্শিয়াল সারোগেসি চলছে এদেশে। আত্মীয় সেজে সারোগেট মা হওয়ার উপায় বার হয়েছে। ‘বজ্র আঁটুনিতে ফস্কা গেরো’র জেরে খরচা তাতে আরও বেড়েছে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা
১) সারোগেট মা কী ভাবে গর্ভবতী হন?
সাধারণত সারোগেট মায়ের জরায়ুতে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করে গর্ভধারণ সম্পন্ন হয়। আইভিএফ পদ্ধতিতে হবু বাবা-মায়ের শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর ( ডোনার এগ বা ডোনার স্পার্মও হতে পারে) মিলনে ভ্রূণ সৃষ্টি করা হয় ল্যাবরেটরিতে। তারপর তা ক্যাথিটারের সাহায্যে গর্ভদাত্রীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এছাড়া আইইউআই পদ্ধতিতে সারোগেট মায়ের গর্ভাশয়ে শুক্রাণু (হবু বাবার হতে পারে বা দাতার থেকে সংগৃহীতও হতে পারে) প্রবেশ করিয়েও গর্ভধারণ সম্পন্ন হতে পারে।
২) সারোগেসির অসুবিধার দিকগুলি কী কী?
সারোগেসির মহান দিকটি হল, এর মাধ্যমে নিঃসন্তানরা সন্তানলাভের সুখ পেতে পারেন। কিন্তু এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। প্রথমত, আইভিএফ বা সহায়ক গর্ভাধান পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় বলে চিকিৎসা সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক জটিলতা রয়েছে। যমজ বা তিনটি সন্তান জন্মের সম্ভাবনা থাকে। মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতের মতো অঘটনও ঘটতে পারে, সেক্ষেত্রে শারীরিক, মানসিক ধকল অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, এই পুরো প্রক্রিয়াটিতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। গর্ভদাত্রী জোগাড় থেকে শুরু করে আবেদন করা সম্মতি পাওয়া, ক্লিনিক খোঁজা ইত্যাদিতে আট-ন’মাস চলে যায়। তারপর গর্ভধারণ ও প্রসবে নির্ধারিত সময় লাগে। এছাড়াও আইনি জটিলতা সামলানো ও মানসিক টানাপোড়েন জয় করার মতো মনের জোর থাকা দরকার।
Related Posts
Written by:
Dr Divya Shandilya
Our Services
Fertility Treatments
Problems with fertility are both emotionally and medically challenging. At Birla Fertility & IVF, we focus on providing you with supportive, personalized care at every step of your journey towards becoming a parent.Male Infertility
Male factor infertility accounts for almost 40%-50% of all infertility cases. Decreased sperm function can be the result of genetic, lifestyle, medical or environmental factors. Fortunately, most causes of male factor infertility can be easily diagnosed and treated.We offer a comprehensive range of sperm retrieval procedures and treatments for couples with male factor infertility or sexual dysfunction.