হিস্টেরো কথার অর্থ হল জরায়ু। আর স্কোপ মানে দেখা। হিস্টেরোস্কোপি-র অর্থ জরায়ুর ভিতরে দেখা। যে যন্ত্রের সাহায্যে এটি করা হয় তার নাম হিস্টেরোস্কোপ। এটা পাতলা টিউবের মতো দেখতে একটা যন্ত্র যার সামনে ক্যামেরা ও আলো লাগানো আছে। যন্ত্রটি জরায়ুমুখের ভিতর দিয়ে জরায়ুতে প্রবেশ করিয়ে দেখা হয় ভিতরে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না। এই যন্ত্রের সাথে অপারেটিভ ইউনিটও থাকে যা দিয়ে ফাইব্রয়েড, পলিপ বা সিস্ট অপসারণের মতো ছোটখাটো অস্ত্রোপচার, বায়োপ্সির জন্য টিস্যু সংগ্রহের মতো কাজ সেরে ফেলা যায় একসঙ্গে।
কেন হিস্টেরোস্কোপি করা হয়?
হিস্টেরোস্কোপির দু’টো কাজ আছে—একটা হল রোগ নির্ণয় (ডায়াগোনিস্টিক) আর একটা হল অস্ত্রোপচার (অপারেটিভ)।যোনি থেকে অস্বাভাবিক রক্তপাত, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, তলপেটে ব্যাথার মতো সমস্যাগুলো হলে চিকিৎসকেরা দেখতে চান জরায়ুর ভিতরে কোনও পলিপ, সিস্ট বা ফাইব্রয়েড তৈরি হয়েছে কি না এবং তার অবস্থান। এছাড়া সন্তানধারণে অক্ষমতার কারণ জানার জন্য বা কোনও মহিলার যদি বারবার গর্ভপাত হয়, তাহলে তা কেন হচ্ছে জানার জন্য জরায়ুর অভ্যন্তর পর্যবেক্ষণের দরকার হয়।
জরায়ুতে জন্মগত খুঁত হিসাবে ফাইব্রাস ব্যান্ড (সেপটামস) থাকলে তা জরায়ু গহ্বরকে দু’ভাগে ভাগ করে। এর ফলে সন্তানধারণ অক্ষমতা, গর্ভপাতের মতো সমস্যা হয়। হিস্টেরোস্কোপি করে এই সমস্যার কথা জানা যায়। পর্যবেক্ষণের পর প্রয়োজন মনে হলে অনেকসময় ফাইব্রয়েড, সেপটামস, পলিপ বা সিস্ট ওই সময়ই অপসারণ করে দেন চিকিৎসকেরা, এটাই হিস্টেরোস্কোপির অপারেটিভ দিক। এই ভাবে পলিপ বাদ দেওয়াকে বলে হিস্টেরোস্কোপি পলিপেক্টোমি আর ফাইব্রয়েড বাদ দেওয়াকে বলে হিস্টেরোস্কোপি মায়োমেক্টোমি।
অনেকসময় আগের কোনও সার্জারি বা রেডিয়েশন থেরাপির জন্য বা সংক্রমণজনিত কারণে স্কার টিস্যু জমে জরায়ু ছোট হয়ে আসে। একে বলে অ্যাশারম্যান সিনড্রোম। এক্ষেত্রে হিস্টেরোস্কোপি করে ওই টিস্যু অপসারণ করা সম্ভব।
হিস্টেরোস্কোপির সাহায্যে জরায়ুতে প্রবেশ করানো জন্মনিরোধক যন্ত্র (আইইউডি) শনাক্তকরণ ও অপসারণ করা যায়। জরায়ুতে বায়োপ্সির জন্যও হিস্টেরোস্কোপি করা হয়। দু’টি মাসিক ঋতুস্রাবের মাধখানে যদি রক্তপাত হয় বা ঋতুস্রাব যদি দীর্ঘ দিন ধরে চলে (অ্যাবনরমাল ইউটেরাইন ব্লিডিং) সেক্ষেত্রে হিস্টেরোস্কোপি পদ্ধতিতে ইউটেরাইন লাইনিংকে বিনষ্ট করে (এন্ডোমেট্রিয়াল অ্যাবলেশন) সমস্যা দূর করা যায়।
হিস্টেরোস্কোপি করার সময়
ঋতুস্রাব শেষ হওয়ার পর প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই হিস্টেরোস্কোপি করা হয় জরায়ুর ভেতরটা ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য। মেনোপজ হয়ে গেলে যে কোনও সময় এটা করা যায়।
হিস্টেরোস্কোপি করার আগে পরীক্ষা
হিস্টেরোস্কোপি করার আগে চিকিৎসক শ্রোণীদেশ পরীক্ষা করে দেখে নেন। প্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষাগুলো করানোর পাশাপাশি সংক্রমণ আছে কি না জানার জন্য পরীক্ষা করা হয়। কারণ পেলভিক ইনফেকশন থাকলে হিস্টেরোস্কোপি করা যায় না। গর্ভাবস্থাতেও হিস্টেরোস্কোপি করা যায় না। তাই গর্ভাবস্থার পরীক্ষাও করা হয়।
হিস্টেরোস্কোপির প্রস্তুতি
প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলি করে নেওয়ার পর চিকিৎসক হিস্টেরোস্কোপি কবে করা হবে সেই দিনটি স্থির করেন। কয়েক দিন আগে থেকে অ্যাসপিরিন এবং ওয়ারফারিনের মতো রক্ত পাতলা করার ওষুধ খাওয়া বন্ধ রাখতে বলা হয়। সার্ভিক্স বা জরায়ুমুখ খোলার জন্য ওষুধ দিতে পারেন চিকিৎসক যেটি হিস্টেরোস্কোপ ঢোকানো সহজ করে তোলে। সাধারণত হিস্টেরোস্কোপের ৪-১২ ঘণ্টা আগে এই ওষুধটি নিতে বলা হয়। অস্ত্রোপচারের আগের দিন মধ্যরাতের পর রোগীকে কিছু খাওয়া বা পান না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
হিস্টেরোস্কোপি পদ্ধতি
তিন ভাবে অ্যানাস্থেশিয়া করা যায়। স্থানীয় বা লোকাল অ্যানাস্থেশিয়ার ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের জায়গাটি শুধু অসাড় করা হয় কম সময়ের জন্য। রিজিওনাল বা আঞ্চলিক অ্যানাস্থেশিয়ার ক্ষেত্রে শরীরের আরও কিছুটা অংশ জুড়ে অসাড় করা হয় এবং এটা একটু বেশি সময় ধরে থাকে। আর সাধারণ অ্যানাস্থেশিয়ার ক্ষেত্রে রোগী সংজ্ঞাহীন হয়ে শুয়ে থাকেন বা ঘুমিয়ে থাকেন বলা চলে। এক্ষেত্রে জ্ঞান ফিরতে বেশ খানিকটা সময় লাগে।
এরপর চিকিৎসক স্পেকুলাম নামে একটি যন্ত্রের সাহায্যে জরায়ুমুখকে চওড়া করেন। তারপর সেখান দিয়ে পাতলা নলের আকারের হিস্টেরোস্কোপ ঢোকানো হয় জরায়ুতে। হিস্টেরোস্কোপের সাহায্যে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বা বিশেষ একটি তরল উপাদান (স্যালাইন সলিউশান ০.৯ শতাংশ) ভিতরে পাঠানো হয় ‘সারফেসে’র রক্ত ও মিউকাস সরিয়ে স্পষ্ট ছবি দেখার জন্য।
এরপর হিস্টেরোস্কোপ-এর আলো আর ক্যামেরার সাহায্যে ভিতরের ছবি মনিটরে দেখেন চিকিৎসকেরা।
যদি অস্ত্রোপচার করা হয়, তাহলে তার অনুসারী যন্ত্র থাকে হিস্টেরোস্কোপ টিউবে।
হিস্টেরোস্কোপির মাধ্যমে কী করা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে প্রক্রিয়াটি শেষ হতে কতটা সময় লাগবে। তবে, মোটামুটি ১০ থেকে ৩০ মিনিট, ক্ষেত্রবিশেষে ১ ঘণ্টা সময় লাগে।
হিস্টেরোস্কোপির পর
লোকাল অ্যানস্থেশিয়া করা হলে এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যেই ক্লিনিক থেকে ছেড়ে দেওয়া হয। জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়ার ক্ষেত্রে কয়েক ঘ্টা পরে পুরোপুরি ভাবে জ্ঞান ফিরলে তবে ছাড়া হয়। অ্যানাস্থেশিয়ার প্রভাবে শরীরে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে এক রাত রেখেও দেওয়া হতে পারে পর্যবেক্ষণের জন্য। হিস্টেরোস্কোপি দিয়ে সার্জারি করা হলে চিকিৎসক দু’তিন দিন বাড়িতে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন। আর এমনি পর্যবেক্ষণের কাজ হলে পরদিন থেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যায়। শুধু যৌনসংসর্গ এক থেকে দু’সপ্তাহ বন্ধ রাখতে বলা হয় সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে।
হিস্টেরোস্কোপির ঝুঁকি
সাধারণ ভাবে হিস্টেরোস্কোপি যন্ত্রণাদায়ক নয় এবং নিরাপদ। তবুও কিছু জটিলতা হতে পারে। যেমন, হিস্টেরোস্কোপ বা আনুষঙ্গিক অস্ত্রোপচারের যন্ত্রগুলি জরায়ুর দেওয়ালে ঘষা লেগে ক্ষতি হতে পারে। এক্ষেত্রে রক্তপাত ও ব্যথা হতে পারে। এছাড়া সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। অ্যানাস্থেশিয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে আবার জরায়ুর ভিতরে পরিষ্কার করার জন্য যে তরল উপাদান দেওয়া হয় তাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে শরীরে। তবে সামান্য ব্যথা ও অল্প রক্তপাত বা দাগ হলে চিন্তার কিছু নেই। কয়েকদিনের মধ্যে সেরে যাবে। কিন্ত রক্তপাত যদি বেশি হয় বা ব্যথা ক্রমশ বাড়ে, জ্বর আসে ও কাঁপুনি দেয় তাহলে অতি অবশ্য চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বলা চলে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ২ শতাংশ রোগীর হিস্টেরোস্কোপির পর সমস্যা হয় এবং সেটা গুরুতর পর্যায়ের হয় ১ শতাংশ বা তারও কমের।
হিস্টেরোস্কোপি ও আইভিএফ
প্রাকৃতিক বা জৈবিক উপায়ে যে সব দম্পতির সন্তান হচ্ছে না তাদের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে সহায়ক গর্ভাধান বা অ্যাসিস্টেড কনসেপশন পদ্ধতির বিকল্প বন্দোবস্ত রয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সফল ও জনপ্রিয় হল আইভিএফ। আইভিএফ-এর পুরো কথাটা হল, ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন। ভিট্রো কথার অর্থ শরীরের বাইরে। যে পদ্ধতিতে শরীরের বাইরে কৃত্রিম পরিবেশে জীবন সৃষ্টি করা হয়, তাকে বলে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন। প্রজননক্ষমতা বর্ধনকারী ওষুধ আর প্রযুক্তির মেলবন্ধনে বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক ধাপে সম্পন্ন হয় আইভিএফ। ওষুদের সাহায্যে প্রথমে উৎকৃষ্ট ডিম্বাণু তৈরি করা হয়। সেই ডিম সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে উৎকৃষ্ট শুক্রাণুর সঙ্গে মিলনসাধন করে এক বা একাধিক ভ্রূণের সৃষ্টি হয়। এরপর ক্যাথিটারের সাহায্যে ভ্রূণ মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত করা হয়। প্রাথমিক এতগুলো ধাপ ল্যাবরেটরিতে সম্পন্ন করার পরেও অনেকসময়ই এই ভ্রূণ প্রতিস্থাপিত হতে পারে না ঠিক ভাবে এবং গর্ভপাত হয়ে যায়। এই রকম গর্ভপাতের ঘটনা যদি তিন তিন বার হয় তখন তাকে বলে রিকারেন্ট ইনপ্ল্যান্টেশন ফেলিওর। দু’টো কারণে এই সমস্যা হতে পারে, একটা ভ্রূণের মানের জন্য, যেটা ল্যাবরেটরিতে মাইক্রোস্কোপের তলায় পরীক্ষা করে নির্ধারণ করা যায়। আর একটি হল জরায়ুর সমস্যা। এই পর্যায়ে কাজে আসে হিস্টেরোস্কোপি। জরায়ুর ভিতরে পলিপ, ফাইব্রয়েড, সেপটাম, লাইনিং ইত্যাদি থাকলে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনে সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে হিস্টোরোস্কোপির সাহায্যে সমস্যাটি নির্ণয় করে প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেই সমস্যা দূরও করা যায়। অনেক সময় আইভিএফ শুরু করার আগেই জরায়ুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য হিস্টেরোস্কোপি করে নেন চিকিৎসকেরা। তবে একবার হিস্টেরোস্কোপি করা হলে কম করে তিন মাসের ব্যবধান (বড় অস্ত্রোপচার হলে ৬ মাস) দিয়ে আইভিএফ প্রক্রিয়া শুরু করতে বলা হয়।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা
১) হিস্টেরোস্কোপি আর ল্যাপারোস্কোপির পার্থক্য কী?
ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে আমরা পেটের তলদেশের (পেলভিক) জরায়ু, ডিম্বাশয়, ফ্যালোপিয়ান নালী ইত্যাদি বাইরে থেকে দেখতে পাই। এদের গঠন ও অবস্থান জানা যায়। সেখানে হিস্টেরোস্কোপিতে জরায়ুগহ্বরের ভিতরের ছবি দেখা হয়। হিস্টেরোস্কোপিতে শরীরে কোনও ছিদ্র বা কাঁটাছেড়া করা হয় না, টিউববিশিষ্ট যন্ত্রটি যোনি দিয়ে ভিতরে ঢোকানো হয়। ল্যাপারোস্কোপিতে পেটের তলদেশে ছোট এক বা একাধিক ছিদ্র করে পরীক্ষা ও অস্ত্রোপচার করা হয়।
২) হিস্টেরোস্কোপি কী যন্ত্রণাদায়ক?
পদ্ধতিটি এমনিতে যন্ত্রণাদায়ক নয়। তবুও একটা ধকল যায়। অ্যানাস্থেশিয়ার জের কেটে গেলে সামান্য ব্যথা থাকতে পারে। চিকিৎসক তাই ব্যথার ওষুধ দেন। আসলে হিস্টেরোস্কোপি-র সাহায্যে কী করা হয়েছে, কতক্ষণ ধরে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে তার উপর এটা নির্ভর করে। আর এক এক জন রোগীর শরীরে এক এক রকমের প্রতিক্রিয়া হয়।
৩) হিস্টেরোস্কোপি কী ঋতুস্রাব বন্ধ করে দেয়?
উল্টো, ঋতুস্রাবের সমস্যা দূর করা যায় হিস্টেরোস্কোপিতে। যে কারণে সমস্যা, সেই পলিপ, ফাইব্রয়েড ইত্যাদি অপসারণ করলে পর বরং ঋতুস্রাব নিয়মিত হবে আর ব্যথা কমে যাবে। তবে, একবার হিস্টেরোস্কোপি করার পর প্রথম মাসটা সামান্য রক্তপাত, দাগ দেখা যায় এবং এই মাসের ঋতুস্রাব অনিয়মিত হতে পারে।