ভ্রূণ প্রতিস্থাপনে সন্তানলাভের সৌভাগ্য
কথায় বলে, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আমাদের এই জীবনে চলার পথে কত চড়াই উতরাই, হাজারো বাধা। কিন্তু সবসময়ই সমস্যা যেমন থাকে, তেমন তার সমাধানও থাকে। যেমন, কোনও দম্পতি যদি এক বছর চেষ্টা করার পরও সন্তানধারণ না করতে পারে, সেক্ষেত্রে তাদের কোথাও একটা সমস্যা আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এই সমস্যাটি পুষে না রেখে ওই দম্পতি যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের কাছে যাবে, তত তাড়াতাড়ি এর সমাধান হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর প্রথমে ওষুধ বা ইনঞ্জেকশন দিয়ে সমস্যার কারণ দূর করার চেষ্টা করেন চিকিৎসকেরা। অনেক সময়ে ল্যাপারোস্কোপি-হিস্টিরিয়োস্কোপি করা হয়। এই সবে কাজ না হলে আইভিএফ পদ্ধতিতে ল্যাবরেটরিতেই উৎকৃষ্ট শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনসাধনে এক বা একাধিক ভ্রূণের সৃষ্টি করে তা ক্যাথিটারের সাহায্যে মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত করা যায়।
কেন ভ্রূণ স্থানান্তর প্রয়োজন?
ভ্রূণ স্থানান্তর তাদের জন্য একটি চমৎকার বিকল্প যাদের নিম্নলিখিত সমস্যা রয়েছে:
- ফ্যালোপিয়ান টিউবের ক্ষতি বা ব্লকেজ: যদি আপনার ফ্যালোপিয়ান টিউব ক্ষতিগ্রস্ত বা ব্লক হয়ে যায়, তাহলে ডিম্বাণু নিষিক্ত হতে এবং জরায়ুতে যেতে কষ্ট করবে।
- ডিম্বস্ফোটনে অসুবিধা: অনিয়মিত বা অনুপস্থিত মাসিক চক্রের ফলে নিষেকের জন্য কম ডিম্বাণু পাওয়া যায়, যা প্রাকৃতিক গর্ভাবস্থাকে আরও কঠিন করে তোলে।
- এন্ডোমেট্রিওসিস: এটি ডিম্বাশয়, জরায়ু এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে যখন জরায়ু টিস্যু একজন মহিলার জরায়ুর বাইরে রোপণ করা হয় এবং বৃদ্ধি পায়।
- জরায়ুতে ফাইব্রয়েড: এগুলি জরায়ুর দেয়ালে থাকা টিউমার যা ভ্রূণ ইমপ্লান্টেশনে সমস্যা করতে পারে, যা একটি সফল গর্ভাবস্থার জন্য প্রয়োজনীয়।
- টিউবাল লাইগেশন: যদি আপনার ফ্যালোপিয়ান টিউব স্থায়ীভাবে কেটে ফেলা হয় বা অপসারণ করা হয়, তাহলে IVF এবং ভ্রূণ স্থানান্তর আপনাকে গর্ভধারণে সাহায্য করতে পারে।
- অপর্যাপ্ত শুক্রাণুর গতিশীলতা: পুরুষের অনুর্বরতা সাধারণ, যা সমস্ত অনুর্বরতার ক্ষেত্রে এক-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী। ডিম্বাণু নিষিক্ত করার জন্য ICSI এর ফলে ইমপ্লান্টেশনের জন্য একটি কার্যকর ভ্রূণ তৈরি হতে পারে।
ভ্রূণ প্রতিস্থাপন পদ্ধতি
আইভিএফ-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শেষ ধাপটি হল ভ্রূণ প্রতিস্থাপন। মহিলা ও পুরুষসঙ্গীর ডিম্বাণু ও শুক্রাণু (দাতার থেকেও সংগ্রহ করা হতে পারে) ল্যাবরেটরিতে নিষিক্তকরণের পরে ভ্রূণ তৈরি হয় চিরাচরিত পদ্ধতিতে বা শুক্রাণুকে সরাসরি ডিম্বাণুতে ইঞ্জেক্ট করে (আইসিএসআই)।
ভ্রূণ তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে তা ইনকিউবেটরে রাখা হয়। পাঁচ থেকে ছ’দিনের মাথায় আট কোষ, ষোলো কোষ বা ব্লাস্টোসিস্ট অবস্থায় ভ্রূণ মায়ের গর্ভে প্রতিস্থাপিত করা হয়। সদ্য তৈরি ভ্রূণ ছাড়াও অনেকসময় সংরক্ষিত (ফ্রোজেন) ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা হয়, যেটি আগে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছিল। একে বলে ফ্রোজেন এমব্রায়ো ট্রান্সফার বা এফইটি।
গবেষণায় প্রমাণিত, সংরক্ষিত ভ্রূণের গুণগত মানে কোনও ফারাক হয় না।
ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের কাজটি অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে করতে হয়। এই পর্বে এক বা একাধিক ভ্রূণ সহযোগে ক্যাথিটার যোনির মধ্য দিয়ে জরায়ু গহ্বরের মাঝখানে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্যাথিটারের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করার জন্য আলট্রাসাউন্ডের সাহায্য নেন চিকিৎসকেরা।
আদর্শ জায়গাটি (জরায়ুর উপর থেকে ১-২ সেন্টিমিটার ছেড়ে) খুঁজে পাওয়ার পর ভ্রূণ বা ভ্রূণগুলি এন্ডোমেট্রিয়ামে (উপর ও নীচের লাইনিং-এর মাঝে) স্থাপন করা হয়। এরপর ক্যাথিটারটি ধীরে বাইরে বার করে নিয়ে মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করা হয়, ভ্রূণ রয়ে গিয়েছে কিনা। কোনও কারণে ভ্রূণ রয়ে গেলে (বিরল ঘটনা) সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথিটারটি পুনরায় প্রবেশ করিয়ে প্রতিস্থাপনের কাজ সম্পন্ন করা হয়।
ভ্রূণ স্থানান্তরের প্রস্তুতি
যদি আপনি IVF করার কথা ভাবছেন, তাহলে আপনি হয়তো ভাবছেন কিভাবে ভ্রূণ স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুতি নেবেন। ভ্রূণ স্থানান্তর প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সহজ, তবে সফল স্থানান্তর নিশ্চিত করতে আপনি কিছু জিনিস করতে পারেন।
- এই প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ডাক্তার বা উর্বরতা ক্লিনিকে আপনার যেকোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে ভুলবেন না যাতে আপনি জানতে পারেন কী আশা করা যায়।
- প্রক্রিয়াটির আগে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিন এবং চাপমুক্ত থাকুন। এটি আপনার শরীরকে ভ্রূণের প্রতি আরও গ্রহণযোগ্য হতে সাহায্য করতে পারে।
- স্থানান্তরের আগে স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং ধূমপান এবং মদ্যপান এড়িয়ে চলুন। এটি আপনার সাফল্যের সম্ভাবনা উন্নত করতে সাহায্য করবে।
আপনার ডাক্তার এবং আপনার মেডিকেল টিমের উপর আস্থা রাখুন। তারা আপনাকে প্রতিটি ধাপে পথ দেখাবে এবং সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করবে।
ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের পর
আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বিশ্রামের পরে ক্লিনিকে ছেড়ে দেয়। তবে, বাড়িতে এক থেকে দু’দিন যতটা সম্ভব বিশ্রামে থাকাই ভাল। কারণ এই সময়ের মধ্যে ভ্রূণটি জরায়ুর দেওয়ালে জোড়ে (অ্যাটাচ)। পুরোপুরি ‘ইমপ্ল্যান্ট’ হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগে।
জরায়ু যাতে ভ্রূণ ধরে রাখতে পারে তার জন্য প্রোজেস্টেরন এবং কখনও কখনও ইস্ট্রোজেন দেওয়া হয়। এরপর দু’সপ্তাহের অপেক্ষা। এই সময় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হলেও শারীরিক পরিশ্রম, ওজন তোলা, দৌড়াদৌড়ি ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। নিয়মিত ফোলিক অ্যাসিড নিতে হবে। দু’সপ্তাহ পরে রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যায় গর্ভধারণ সফল হল কিনা। আইভিএফ-এর ক্ষেত্রে বাড়িতে ‘হোম-কিট প্রেগন্যান্সি টেস্ট’ করতে বারণ করা হয়। কারণ আইভিএফ পদ্ধতিতে মহিলাদের শরীরে যে হরমোনগুলি প্রয়োগ করা হয়, তার জন্য অনেকসময় ‘ফলস পজিটিভ রিপোর্ট’ আসে।
সফল ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের লক্ষ্মণ
- স্তনের পরিবর্তন- সফল ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের একেবারে প্রাথমিক লক্ষ্মণ হল স্তনের আকার বৃদ্ধি ও ব্যথা ভাব। গর্ভাবস্থার শুরুতে প্রসূতিদের স্তন আকারে বড় ও শক্ত দেখায়। অনেকের ব্যথা হয়। তবে আইভিএফ-এ যেহেতু ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রয়োগ করা হয়, সেহেতু গর্ভধারণ সফল না হওয়া সত্ত্বেও স্তনের এই পরিবর্তন হতে পারে।
- রক্তের ছোপ- ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের এক সপ্তাহ পরে নিম্নাঙ্গের অম্তর্বাসে রক্তের হালকা ছোপ বা দাগ (স্পটিং) দেখা যেতে পারে। জরায়ুর লাইনিং-এ ভ্রূণ আটকানোর সময় এই দাগ হওয়া স্বাভাবিক।
- পেট ফোলা- ঋতুস্রাবের শুরুর সময় তলপেটে যেমন একটা ফোলা ভারী ভাব থাকে, তেমনটা ভ্রূণ প্রতিস্থাপন সফল হওয়ার পর অনুভূত হতে পারে। এটার কারণ হল গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে প্রসূতির শরীরে প্রোজেস্টেরনের লেভেল বেড়ে যায়। তলপেটে ফোলা ভাবের কারণ প্রোজেস্টেরন। তবে, এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে সঙ্গে যন্ত্রণা হচ্ছে কি না। কারণ এটা তখন ওভারিয়ান হাইপারস্টিমুলেশন সিনড্রোমের (ওএইচএসএস) লক্ষ্মণ হতে পারে। আইভিএফ পদ্ধতিতে উর্বর ডিম্বাণু তৈরি করার জন্য যে হরমোন প্রয়োগ করা হয় তার জেরে ডিম্বাশয় ফুলে যায়। তবে, খুব কম ক্ষেত্রে (০.৫% – ৫ %) এটি চিন্তার কারণ হয়।
- তলপেটে ব্যথা- তলপেটে হালকা মোচড়ের মতো ব্যথা হতে পারে। গর্ভাবস্থার শুরুতে অনেকের এই লক্ষ্মণ হয়। ভ্রূণকে ভালভাবে জায়গা করে দেওয়ার জন্য প্রোজেস্টেরন এই সময় সংশ্লিষ্ট পেশী ও লিগামেন্টগুলোকে দুর্বল করে দেয়। সেই কারণেই এই ব্যথা হয়।
- মাথা ঘোরা- সাধারণ গর্ভধারণের ক্ষেত্রে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের মাথায় বমি ভাব ও মাথা ঘোরার মতো লক্ষ্মণ দেখা যায়। কিন্তু আইভিএফ-এ সফল ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের পরেই এই লক্ষ্মণ দেখা দেয়।
- যোনিস্রাব- যোনিস্রাব বৃদ্ধি পাওয়া সফল ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের পরে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা লক্ষ্মণ। হালকা সাদা বা স্বচ্ছ, তরল এই স্রাব জরায়ুতে সংক্রমণ হতে দেয় না।
- ক্লান্তি ভাব ও দুর্বলতা- এই উপসর্গও প্রোজেস্টেরনের জন্য হয় এবং শুরু থেকেই এটা হয়।
- ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের পর উপরের এই লক্ষ্মণগুলোর কোনওটাই দেখা না দিলে চিন্তার কিছু নেই। কারণ বহু প্রসূতির ক্ষেত্রেই সফল গর্ভধারণের কোনও লক্ষ্মণ বা উপসর্গ থাকে না।
হিমায়িত ভ্রূণ স্থানান্তর (FET) এর জন্য করণীয় এবং করণীয়
সফল এবং সুস্থ গর্ভধারণের সম্ভাবনাকে অপ্টিমাইজ করার জন্য এখানে কয়েকটি করণীয় এবং কী করবেন না তা আপনি মনে রাখতে পারেন।
হিমায়িত ভ্রূণ স্থানান্তর (FET) এর জন্য করণীয়
- নির্ধারিত ওষুধ অনুসরণ করুন: ঔষধ আপনার উর্বরতা চিকিত্সক যে ঔষধের সময়সূচী সুপারিশ করেছেন তা ঠিক মেনে চলুন। হরমোন ওষুধ দিয়ে ভ্রূণ রোপনের জন্য জরায়ুর আস্তরণ প্রস্তুত করতে হবে।
- স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুশীলন করুন: একটি সুষম খাদ্য খান, ঘন ঘন, পরিমিত ব্যায়াম করুন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম পান। একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন FET সফল হতে সাহায্য করতে পারে।
- ভাল হাইড্রেটেড থাকুন: সঠিক হাইড্রেশন বজায় রাখা জরায়ুকে সর্বোত্তম রক্ত প্রবাহ পেতে সাহায্য করে, যা একটি গ্রহণযোগ্য জরায়ু আস্তরণের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে।
- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কৌশলে যোগ দিন: যোগব্যায়াম, ধ্যান, বা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো চাপ-হ্রাস ব্যায়ামে নিযুক্ত হন। উচ্চ পরিমাণে চাপ ইমপ্লান্টেশন এবং হরমোনের মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে।
- রুটিন চেক-আপের সময়সূচী করুন: রক্ত পরীক্ষা এবং আল্ট্রাসাউন্ড সহ সমস্ত নিয়মিত মেডিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্টে যোগ দিন। একটি ভ্রূণ স্থানান্তর করার সর্বোত্তম সময় নিয়মিত পর্যবেক্ষণ দ্বারা নিশ্চিত করা হয়।
- সঠিক পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন: সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে, ভ্রূণ স্থানান্তরের আগে এবং পরে আপনার ক্লিনিক দ্বারা প্রদত্ত স্বাস্থ্যবিধি নির্দেশাবলী মেনে চলুন।
- ভালোভাবে অবগত থাকুন: সম্পূর্ণ এফইটি পদ্ধতি, সম্ভাব্য ফার্মাসিউটিক্যাল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং আপনার ডাক্তারের পরামর্শ দেওয়া যেকোনো বিধিনিষেধ বুঝুন।
- আরামদায়ক পোশাক: স্থানান্তরের দিনে চাপ এবং শারীরিক অস্বস্তি কমাতে, আরামদায়ক পোশাক পরুন।
- ডাক্তারের নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন: উপবাস, স্থানান্তরের আগে ওষুধ গ্রহণ এবং স্থানান্তর-পরবর্তী নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আপনার ডাক্তারের নির্দেশাবলী সাবধানে অনুসরণ করুন।
হিমায়িত ভ্রূণ স্থানান্তর (FET) এর জন্য করবেন না
- অতিরিক্ত ক্যাফেইন সীমিত করুন: অত্যধিক ক্যাফেইন গ্রহণ করা এড়িয়ে চলুন, যা জরায়ুর রক্ত প্রবাহকে ব্যাহত করতে পারে।
- কঠোর কার্যকলাপ এড়িয়ে চলুন: FET পর্যন্ত দিনগুলিতে কঠোর ব্যায়াম বা ভারী উত্তোলন এড়িয়ে চলুন কারণ এই কার্যকলাপগুলি জরায়ুর রক্ত প্রবাহ এবং ইমপ্লান্টেশনকে প্রভাবিত করতে পারে।
- গরম স্নান এবং saunas থেকে দূরে থাকুন: অত্যধিক তাপ ভ্রূণ ইমপ্লান্টেশনে হস্তক্ষেপ করতে পারে, তাই গরম স্নান, সনা এবং গরম টব থেকে দূরে থাকুন।
- নির্ধারিত ওষুধগুলি এড়িয়ে যাবেন না: প্রস্তাবিত সময়সূচী মেনে আপনার ওষুধের ডোজ এড়িয়ে চলুন। আদর্শ হরমোন পরিবেশ তৈরি করার জন্য ধারাবাহিকতা প্রয়োজন।
- অতিরিক্ত লবণ খাওয়া এড়িয়ে চলুন: একটি সুষম খাদ্য প্রয়োজন, কিন্তু অত্যধিক লবণ খরচ ফুলে যাওয়া এবং জল ধরে রাখার কারণ হতে পারে।
- চাপযুক্ত কার্যকলাপ সীমিত করুন: হরমোন স্তর এবং সাধারণ সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন উচ্চ-চাপের কার্যকলাপগুলি এড়িয়ে চলুন।
- যৌন মিলন থেকে বিরত থাকুন: ভ্রূণ ইমপ্লান্টেশন প্রক্রিয়ার সম্ভাব্য বাধা এড়াতে, আপনার ডাক্তার FET এর আগে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যৌন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতে পারেন।
- অ্যালকোহল, তামাক এবং ড্রাগ ব্যবহার এড়িয়ে চলুন: যেহেতু তারা উর্বরতা এবং ভ্রূণ রোপনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, তাই FET চক্রের সময় অ্যালকোহল, ড্রাগ এবং তামাক ব্যবহার এড়ানো উচিত।
- পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে সমর্থন চাও: যদিও FET পদ্ধতির সময় উদ্বিগ্ন বোধ করা সাধারণ, আপনার চাপ এবং উদ্বেগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন। সমর্থন, সান্ত্বনা এবং সান্ত্বনার জন্য আপনার বন্ধুদের এবং পরিবারের সাথে যোগাযোগ করুন।
মনে রাখবেন যে প্রত্যেকের যাত্রা ভিন্ন, এবং আপনার উর্বরতা ডাক্তারের দেওয়া নির্দেশাবলী মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি একটি সফল হিমায়িত ভ্রূণ স্থানান্তরের সম্ভাবনা বাড়াতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত এই করণীয় এবং করণীয়গুলি অনুসরণ করে একটি পরিবার শুরু করার আপনার লক্ষ্যে সফল হতে পারেন।
ব্যর্থ ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের লক্ষ্মণ
জরায়ুতে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের পরে-পরেই বোঝা যায় না, সফল হল কিনা। এর জন্য কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হয়। ভ্রূণ কোনও কারণে জরায়ুর দেওয়ালে প্রতিস্থাপিত না হতে পারলে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এই পরিস্থিতি নানা কারণে হতে পারে। ভ্রূণের গুণগত মানের জন্য এটা হতে পারে আবার জরায়ুতে কোনও সমস্যা থাকার জন্য এটা হতে পারে। আধুনিক জীবনযাত্রাও অনেকসময় গর্ভধারণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন ধূমপানের কারণে বা ওজন বেশি হলে ‘ইমপ্ল্যান্টেশনে’ সমস্যা হয়। দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেসের জন্যও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে সমস্যা হতে পারে। গোলমেলে বিষয় হল, যে লক্ষ্মণগুলো দেখে মনে করা হয় গর্ভধারণ সফল হয়েছে, সেগুলিই আবার ব্যর্থতার লক্ষ্মণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন,
- তলপেটে ব্যথা ও রক্তপাত- ঋতুস্রাবের সময় শরীরে যে পরিবর্তনগুলো আসে, সেগুলো সবই গর্ভপাতের সময় অনুভূত হতে পারে। যেমন, তলপেটে ব্যথা, পিঠের নীচের দিকে ব্যথা, রক্তপাত, মাথা ঘোরা, বমি ভাব ইত্যাদি।
- নেগেটিভ প্রেগন্যান্সি রেজাল্ট- প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে দেখা হয় শরীরে এইচসিজি হরমোনের উপস্থিতির হার। ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের দু’সপ্তাহ পরেও এই হরমোন শরীরে পাওয়া না গেলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা ‘নেগেটিভ’ ধরে নেওয়া হয়।
- আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা- অনেকসময় প্রাথমিক লক্ষ্মণে মনে হয় সফল, এমনকী রক্ত পরীক্ষার ফলেও পজিটিভ রেজাল্ট আসে। কিন্তু তারপরে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষায় দেখা যায়, সফল হয়নি। এটা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে হতে পারে। যেমন, কেমিক্যাল প্রেগন্যান্সি। যখন ভ্রূণ জরায়ুর দেওয়ালে গাঁথে না বা গাঁথার পরেও আর বাড়তে পারে না বা বিকশিত হতে পারে না, তখন তাকে কেমিক্যাল প্রেগন্যান্সি বলে। এক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষায় পজিটিভ রেজাল্ট পাওয়া যায় এবং ঋতুস্রাবও বন্ধ থাকে। তাই আপাত ভাবে মনে হয় গর্ভধারণ সফল হয়েছে। একমাত্র আলট্রাসাউন্ডে বোঝা যায় যে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন আদপে ব্যর্থ হয়েছে।
অনেকসময় আবার গর্ভপাত হয়ে গেলেও টিস্যু জরায়ুর মধ্যেই থেকে যায় বলে বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
এছাড়া ইক্টোপিক প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনাও থাকে আইভিএফে। যখন ভ্রূণ জরায়ুর মধ্যে না থেকে ফ্যালোপিয়ান টিউবে বন্দি হয়ে যায় তখন তাকে ইক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বলে। এক্ষেত্রে প্রেগন্যান্সি টেস্টে রেজাল্ট পজিটিভ আসে। কিন্তু পেটে ব্যথা, রক্তপাতের মতো লক্ষ্মণগুলো দেখা যায়। সময়ে এটি নির্ধারণ না হলে এবং চিকিৎসা না হলে প্রাণসংশয় পর্যন্ত হতে পারে।
পরবর্তী পদক্ষেপ
ভ্রূণ প্রতিস্থাপন সফল হলে প্রসূতি বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে পরবর্তী চিকিৎসা হবে।
ব্যর্থ হলে বিরক্তি, অবসাদ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি ভাবনা মনকে গ্রাস করে। এটা স্বাভাবিক। তা বলে এই ভাবনাগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপরে ভরসা রাখতে হবে। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হলে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে হবে। ব্যায়াম, শরীরচর্চা, খাদ্যাভ্যাস ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যদি কিছু পরিবর্তন আনার দরকার হয়, তা করতে হবে। সাধারণ ভাবে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন ব্যর্থ হলে দুই থেকে তিন মাসের একটা সময় দিতে বলে। যাতে শরীর ও মন সেরে ওঠে সম্পূর্ণ ভাবে। সেই সময়ে চিকিৎসকও দেখে নেবেন, কোথায় গলদ থাকতে পারে। আইভিএফ-এর ভাল দিক হল বেশ কয়েকবার এই চেষ্টা করা যায়। আগের বারের অতিরিক্ত ভ্রূণ সংরক্ষণ করে রাখা থাকলে শুরুর ধাপ এড়ানো যায় এবং এক্ষেত্রে মাঝে সময়ের বিরতি দেওয়ারও দরকার হয় না।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা
১) ভ্রূণ প্রতিস্থাপন কী যন্ত্রণাদায়ক?
সাধারণ ভাবে এটি যন্ত্রণামুক্ত পদ্ধতি বলা চলে। অ্যানাস্থেশিয়া ছাড়াই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তবে ইনজেকশনের সময় সামান্য যন্ত্রণা হতে পারে, ক্যাথিটার ঢোকানোর সময়ও অস্বস্তি হয়। আলট্রাসাউন্ডের জন্য পূর্ণ মূত্রথলি (ফুল বাল্ডার) দরকার, যাতে অনেকের অসুবিধা হয়। তবে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে বেশি সময় লাগে না।
২) জরায়ুতে ক’টি ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা উচিত?
এই সংখ্যা নির্ভর করে মহিলার বয়স ও ক’টি উন্নত মানের ডিম্বাণু পাওয়া গিয়েছে তার উপর। শুরুতেই এই নিয়ে আলোচনা করে নেওয়া ভাল। সাধারণত ৩৭ এর কম বয়স হলে এবং প্রথমবার আইভিএফ হলে একটি ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা হয়। ৪০-এর বেশি বয়স হলে দু’টি ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। মহিলার গর্ভধারণের সম্ভাবনা খুব কম থাকলে তিন বা ততোধিক ভ্রূণও ( হেভি লোড ট্রান্সফার বা এইচএলটি) প্রতিস্থাপন করা হয়।
৩) ৩ দিনের ভ্রূণ স্থানান্তরের পর কি হয়?
৩ দিন বয়সী ভ্রূণ স্থানান্তরের পর তৃতীয় দিনে, হ্যাচিং সম্পূর্ণ হয়। ভ্রূণের ডিমের বাইরের খোসা খোলা হয়, যেখান থেকে ডিপ্লয়েড কোষ বের হয়, জরায়ুর আস্তরণে ইমপ্লান্টেশনের জন্য প্রস্তুত বা ইমপ্লান্টেশন শুরু হয়।
৪) প্রথমে কোন ভ্রূণ স্থানান্তর করতে হয়?
ভ্রূণ স্থানান্তরের পর্যায় ভ্রূণের সংখ্যা এবং বিকাশের পর্যায়ের উপর নির্ভর করে। ভ্রূণ স্থানান্তরের প্রধান ধাপগুলি হল ক্লিভেজ পর্যায় (সহ-ইনকিউবেশনের পর ২য় থেকে ৪র্থ দিন) অথবা ব্লাস্টোসিস্ট পর্যায় (সহ-ইনকিউবেশনের পর ৫ম বা ৬ষ্ঠ দিন)।
৫) পিরিয়ডের কত দিন পর ভ্রূণ স্থানান্তর করা হয়?
আইভিএফ চিকিৎসায়, সাধারণত ডিম্বস্ফোটনের প্রায় ৫-৬ দিন পরে, অর্থাৎ মাসিক চক্রের ১৯-২০ দিনের কাছাকাছি ভ্রূণ স্থানান্তর করা হয়। এই সময়ে জরায়ুর স্তর সবচেয়ে ঘন হয়ে ওঠে, যা ভ্রূণের ইমপ্লান্টেশনকে উৎসাহিত করে।