সার্ভিকাল ক্যানসার হল একধরণের ক্যানসার যা মহিলাদের বেশী হয়। যদিও, ভালো দিক হল অন্য ক্যানসারের থেকে এই ক্যানসার নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেশী। হিউম্যান প্যাপিলোম্যাভিরাস (HPV) স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে সার্ভিকাল ক্যানসারকে যদি প্রথম ধাপেই চিনে নেওয়া যায়, তাহলে ভ্যাকসিন নেওয়া এবং জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমেই এই রোগকে বশে আনা যায়। যদিও, এতরকম নিরাময় ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, প্রতি বছর পুরো পৃথিবী জুড়ে বহু মহিলা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। সেইজন্য, এই রোগের সাথে মোকাবিলা করতে গেলে এর সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ও সচেতনতা থাকা খুবই প্রয়োজনীয়। এই প্রবন্ধে, আমরা সার্ভিকাল ক্যানসারের লক্ষণ থেকে এর স্ক্রিনিং, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা এই সবকিছু নিয়ে আলোচনা করবো।
সার্ভিকাল ক্যানসার কি?
সার্ভিক্সে কোনো অসংলগ্ন কোশ এলোমেলোভাবে বেড়ে উঠতে থাকলে তা থেকে সার্ভিকাল ক্যানসার হয়ে থাকে। সার্ভিক্স হল ইউটেরাসের নীচের দিকের সরু অংশটি যা ইউটেরাসকে ভ্যাজাইনার সাথে যুক্ত করছে। সার্ভিকাল ক্যানসারের মূল কারণ হল দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণ এর সাথে HPV র সবেচেয়ে ক্ষতিকারক স্ট্রেন। অনেকক্ষেত্রে, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাই এই ভাইরাসকে শেষ করে দিতে পারে। যদি, কোনো মহিলার দেহে, এই ভাইরাস বেশীদিন থেকে যায়। তখন সে একের পর সার্ভিকাল কোশগুলিতে অসংলগ্নভাবে ছড়িয়ে পড়ে সার্ভিকাল ক্যানসারের রূপ ধারণ করে।
সার্ভিকাল ক্যানসারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কেন?
বিশ্বব্যাপী তথ্যানুযায়ী, সার্ভিকাল ক্যানসার মহিলাদের শরীরে পাওয়া চতুর্থ সাধারণ ক্যানসারের মধ্যে একটা। প্রতি বছর, কয়েক লাখ এরকম কেসের রিপোর্ট করা হয়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশানের (WHO) তথ্য অনুযায়ী 2022 সালে, পুরো পৃথিবীতে প্রায় ছয় লাখ 60 হাজার সার্ভিকাল ক্যানসারের কেস পাওয়া গেছে আর তার মধ্যে প্রায় তিন লাখ 50 হাজার মহিলা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সেইসমস্ত দেশ যেখানে রোগনির্ণয় করার সরঞ্জাম অনেক সীমিত, সেখানে ক্যানসার রোগটি নির্ণয় করতেই অনেক সময় লেগে যায় যার ফলে বেশী মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে, যেখানে রোগ নির্ণয় ও ভ্যাকসিন পাওয়ার ব্যবস্থা তুলনামূলক ভালো সেখানে এই রোগে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর হার অনেক কম।
সার্ভিকাল ক্যানসার নিরাময়ের অনেকগুলি উল্লেখযোগ্য উপায় আছে যার মধ্যে একটি হল, HPV র জন্য সঠিক টীকাকরণ, আর এর সাথে ঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থা। 2030 সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশানের লক্ষ্য হল ব্যপক হারে টীকাকরণ ও স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে সার্ভিকাল ক্যানসারকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
শরীরে সার্ভিক্সের ভূমিকা কি
জনন প্রক্রিয়ায় সার্ভিক্সের ভূমিকা ভীষণভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি স্পার্মকে ইউটেরাস অবধি পৌঁছনোর জায়গা করে দেয়, পিরিয়ড চলাকালীন মাসিক রক্তের সঠিকভাবে বেরিয়ে যেতে দেয়, এবং শিশুজন্ম যাতে সঠিকভাবে হয় তার জন্য সঠিকভাবে প্রসারিত হয়ে যায়। এর অবস্থানের জায়গা এবং শরীরের গঠনের কারণে, সার্ভিক্সের সংক্রমিত হওয়ার অনেক ঝুঁকি থাকে এবং যার ফলে এটি হিউমান প্যাপিলোমাভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
যদিও বেশীরভাগ HPV সংক্রমণ নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু যদি কোনো সংক্রমণ থেকে যায়, তখন এটি সার্ভিক্সের বিভিন্ন কোশে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে। যদি সময়মত চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে ক্যানসার এর চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
সার্ভিকাল ক্যানসারের লক্ষণ
অনেকসময় সার্ভিকাল ক্যানসারের আসল লক্ষণগুলি প্রথমেই ধরতে পারা যায় না। যদিও, এটি যত বাড়তে থাকে, আরও বিভিন্নধরনের লক্ষণ দেখা দিতে থাকে। সঠিক সময়ে এই লক্ষণগুলি ধরতে পারলে এবং ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে পারলে সঠিক চিকিৎসা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এবার তাহলে সার্ভিকাল ক্যানসারের লক্ষণগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাক:
সার্ভিকাল ক্যানসারের সাধারণ লক্ষণ
- অসংলগ্ন রক্তপাত
- পিরিয়ড চলাকালীন রক্তপাত
- অনেকদিন ধরে পিরিয়ড চলতে থাকা
- মেনোপজের পরে রক্তপাত
- যৌনমিলনের পর রক্তপাত
- ভ্যাজাইনা থেকে নির্গত দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব
যেসব মহিলারা সার্ভিকাল ক্যানসারে আক্রান্ত হয় তাদের ভ্যাজাইনা থেকে অস্বাভাবিকভাবে স্রাব নির্গত হয়। এটির পরিমাণ সাধারণের থেকে অনেকটাই বেশী হয় এবং তার সাথে দুর্গন্ধও থাকে।
- উরুতে যন্ত্রণা
যৌন মিলনের সময় উরুতে দীর্ঘক্ষণ চলতে থাকা যন্ত্রণাও সার্ভিকাল ক্যানসারের এক লক্ষণ। বিশেষ করে ক্যানসার এক পর্যায়ে পৌঁছনোর পর এই যন্ত্রণাকে যথেষ্ট উপলব্ধি করা যায়।
- প্রস্রাব ও মলত্যাগে সমস্যা
বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে, সার্ভিকাল ক্যানসার কাছাকাছি থাকা অঙ্গগুলিতেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে যেমন ব্লাডার অথবা রেকটাম। যার ফলে অনবরত প্রস্রাব হয়। লক্ষণ হিসেবে প্রস্রাব করতে অসুবিধা, মূত্রের সাথে রক্ত নির্গত হওয়া অথবা মলত্যাগে অসুবিধা দেখতে পাওয়া যায়।
- ক্লান্তিবোধ এবং ওজন কমে যাওয়া
হঠাৎ করে অনেকটা ওজন কমে যাওয়া আর ভীষণভাবে ক্লান্তিবোধ করা সার্ভিকাল ক্যানসারের লক্ষণ। এর কারণ হল এই রোগের সাথে মোকাবিলা শরীর থেকে যথেষ্ট এনার্জি ক্ষয় হয়।
কখন ডাক্তার দেখানো উচিত?
আপনার শরীরে আপনি যদি উপরিলিখিত কোনো লক্ষণ অনুভব করেন, তাহলে শীঘ্রই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। ক্যানসারের ক্ষেত্রে, যত দেরী করবেন তত ঝুঁকি বাড়বে। যদিও, এইধরনের লক্ষণ সার্ভিকাল ক্যানসার ছাড়াও অন্য রোগের ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে, কিন্তু সময়মত চিকিৎসা করা হলে, সঠিক এবং সফল চিকিৎসা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সার্ভিকাল ক্যানসারের কারণ
সার্ভিকাল ক্যানসারের মূল কারণ হল সংক্রমণ এর সাথে থাকা HPV ভাইরাসের উচ্চঝুঁকিসম্পন্ন কোনো রূপ। যদিও, আরও অনেক বিষয় এই ক্যানসার হওয়ার জন্য দায়ী। এই রোগের সাথে মোকাবিলা করার জন্য সেসব কারণগুলি সম্পর্কে সঠিক তথ্য থাকা প্রয়োজন।
- HPV সংক্রমণ
হিউমান প্যাপিলোমাভাইরাস (HPV) হল 100 টি ভাইরাসের একটি দল, এর শুধুমাত্র কিছু স্ট্রেনই সার্ভিকাল ক্যানসারের জন্য দায়ী। HPV সাধারণত যৌন মিলনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেইজন্য, যেসব মহিলারা খুব অহরহ যৌন মিলন করে থাকেন তারাই বেশীরভাগ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। যে দুটি সাধারণ উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন স্ট্রেন সার্ভিকাল ক্যানসার হওয়ার মূল কারণ তারা হল HPV-16 এবং HPV-18। পুরো পৃথিবীতে দেখা সার্ভিকাল ক্যানসারের 76 শতাংশ ক্ষেত্রেই এই দুটি স্ট্রেন দায়ী।
HPV সংক্রমণ নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে, এই ভাইরাস মানবদেহে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে এবং অন্যান্য সার্ভিকাল কোশগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করে। পরে এটি ক্যানসারের আকার ধারণ করে।
- ধূম্রপান
ধূম্রপান সরাসরি শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে একে দুর্বল করে দেয়। সেই কারণে, অন্য সংক্রমণের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা যাতে HPVও অন্তর্ভুক্ত সবটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তথ্যানুসারে, যেসমস্ত মহিলারা ধূম্রপান করে তাদের সার্ভিকাল ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা যারা ধূম্রপান করেনা তাদের তুলনায় অনেক বেশী হয়। এছাড়াও, ধূম্রপানের ফলে অন্য কোনো ক্যানসার এবং অন্য কোনো শ্বাস জনিত রোগের সূত্রপাত হয়।
- দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা
যেসব লোকেদের রোগপ্রতিরোধক্ষমতা ক্ষমতা খুব দুর্বল তার সহজেই সার্ভিকাল ক্যানসার হয়। যেমন, HIV। এই ক্যানসার যেসব মহিলাদের AIDS আছে তাদের শরীরে খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ কিন্তু পরিস্কার। একটি দুর্বল রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতা HPV সংক্রমণ এবং অন্য ক্যানসার সঙ্ক্রামকের সাথে মোকাবিলা করতে অক্ষম।
- কমবয়সে যৌনমিলন এবং একাধিক সঙ্গী বদল
তথ্যানুযায়ী, কম বয়সে যৌন মিলন HPV সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এর সাথে, একাধিক সঙ্গীর সাথে যৌন মিলনও HPV ছড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। যৌন মিলনের সময় কনডমের ব্যবহার HPV এবং অন্যান্য যৌন সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ইনফেকশন (STIs) করে।
- অন্যান্য কারণ
- গর্ভনিরোধক বড়ি: বারবার গর্ভনিরোধক বড়ি খাওয়ার ফলেও সার্ভিকাল ক্যানসার হতে পারে এবং ছড়িয়েও দিতে পারে।
- পরিবারের কারোর যদি আগে হয়ে থাকে: পরিবারের কোনো মহিলার যদি সার্ভিকাল ক্যানসার হওয়ার ইতিহাস থেকে থাকে তাহলে তার থেকেও এই রোগটি হতে পারে।
- বাজে খাদ্যাভ্যাস: প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবের কারণে, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং এর ফলে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সেইজন্য, নিয়মিত খাদ্যে সবরকম পুষ্টি অন্তর্ভুক্ত থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
নিম্নলিখিত ছকের মাধ্যমে উপরল্লিখিত কারণগুলি সহজে বোঝার চেষ্টা করি।
কারণ | প্রভাব |
HPV সংক্রমণ | সার্ভিকাল ক্যানসারের 75% কারণ |
ধূম্রপান | সার্ভিকাল ক্যানসারের দ্বিগুণ ঝুঁকি |
দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা | HPV সংক্রমণের সাথে লড়াই করতে ব্যর্থ |
কমবয়সে যৌনমিলন | HPV সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় |
সার্ভিকাল ক্যানসারের ধরণ
সার্ভিকাল ক্যানসারে যেসমস্ত কোশগুলি ক্যানসারে আক্রান্ত হয় তার ওপর নির্ভর করে। সার্ভিকাল ক্যানসারের দুটি আসল ধরণ হল:
স্কোয়ামাশ সেল কার্সিনোমা
স্কোয়ামাশ সেল কার্সিনোমা হল সার্ভিকাল ক্যানসারের সবচেয়ে সাধারণ ধরণ, যা সার্ভিকাল ক্যানসারের প্রায় 70–80% গঠন করে। ক্যানসারটি সার্ভিক্সের বাইরের দিকের পাতলা এবং সরু কোশগুলিতে বেড়ে ওঠে। এটি নিয়মিত প্যাপ স্মিয়ার পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই ধরা যায়, আর এর চিকিৎসাও করা যায়।
অ্যাডিনোকার্সিনোমা
অ্যাডিনোকার্সিনোমা সার্ভিক্স ক্যানালের গ্ল্যাণ্ডুলার কোশে জন্ম নেয়। এই স্কোয়ামাশ সেল কার্সিনোমার মত অত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে না, কিন্তু এটি বেশী ভয়ংকর। এটি নিয়মিত সাধারণ প্যায় স্মিয়ার পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝাও যায় না। যদিও, সফল চিকিৎসার জন্য প্রাথমিক ধরতে পারাটা জরুরী।
সার্ভিকাল ক্যানসারের বিরল ধরণ
সার্ভিকাল ক্যানসারের কিছু বিরল ধরণও রয়েছে। এতে ছোট কোশের কার্সিনোমা, নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমার ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই ক্যানসারগুলি অন্যদের থেকে অনেক বেশী ভয়ংকর এবং চিকিৎসা করাও কঠিন।
সার্ভিকাল ক্যানসার স্ক্রিনিং
সার্ভিকাল ক্যানসার স্ক্রিনিং এর সাহায্যে, এই রোগটিকে একদম প্রাথমিক অবস্থাতেই খুব সহজে শনাক্ত করা যায় এবং রোগীর সেইমত চিকিৎসা শুরু করতেও সুবিধা হয়। এই স্ক্রিনিং এর জন্য অনেকধরনের পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়:
- প্যাম স্মিয়ার টেস্ট (প্যাপানিকোলাও টেস্ট)
সার্ভিকাল ক্যানসার স্ক্রিনিং এর জন্য প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট হল সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এই পরীক্ষাটিই করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে, সার্ভিক্সের সব কোশগুলিকে একবার সরিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা হয় যে তারা কতটা অসংলগ্ন। এর সাহায্যে একদম শুরু শুরুতেই ক্যানসার শনাক্ত করা হয়ে যায়। এই পরীক্ষায়, কোশগুলি ক্যানসারে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই শনাক্ত হয়ে যায়, আর তাড়াতাড়ি চিকিৎসাও শুরু করা যায়।
- HPV DNA টেস্ট
HPV DNA টেস্টের মাধ্যমে এটা দেখা হয় যে সার্ভিকাল কোশে কোনো উচ্চঝুঁকিসম্পন্ন HPV স্ট্রেন রয়েছে কিনা। এই টেস্টটি 30 বছরের ঊর্ধ্ব মহিলাদের প্যাপ স্মিয়ার টেস্টের পাশাপাশি করানো হয়। এটি সার্ভিকাল ক্যানসার কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে তার সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য দিয়ে থাকে।
- অ্যাসেটিক অ্যাসিড দিয়ে চাক্ষুষ পরিদর্শন (VIA)
কম সম্পদের যোগান থাকলে VIA হল প্যাপ স্মিয়ার টেস্টের একটি সাশ্রয়ী বিকল্প। এক্ষেত্রে, ভিনিগারের মত একটি তরলকে সার্ভিক্সে লাগিয়ে দেওয়া হয়, এবং দেখা হয় যে এরপর ওই অসংলগ্ন কোশগুলির রঙ সাদা হতে শুরু করেছে কিনা। এই পদ্ধতিতে, রোগী অত্যাধিক ঝুঁকিতে আছে কিনা সেটা বোঝা যায়। এক্ষেত্রে, আরেকবার স্ক্রিনিং এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করা অবশ্যম্ভাবী।
সার্ভিকাল ক্যানসার স্ক্রিনিং এর নির্দেশাবলী
বয়সের সীমা | কখন স্ক্রিনিং করতে হবে? |
21-29 | প্রতি তিন বছরে একবার প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট |
30-65 | প্রতি পাঁচ বছরে প্যাপ স্মিয়ার টেস্টের সাথে সাথে HPV DNA টেস্টও করতে হবে |
65 এরও বেশী | যদি উপরিক্তগুলির রিপোর্ট সঠিক থাকে, আর পরীক্ষার প্রয়োজন নেই |
সার্ভিকাল ক্যানসার প্রতিরোধের নিয়মাবলী
সার্ভিকাল ক্যানসার প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হল এটি বাড়ার আগেই প্রশমিত করা। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করে আপনি সার্ভিকাল ক্যানসারকে অনেকটা নিরাময় করতে পারবেন। সেইসব পদ্ধতি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল:
- HPV ভ্যাকসিন
HPV ভ্যাকসিন HPVকে প্রতিরোধ করে, যা ক্যানসারের সবচেয়ে সেরা স্ট্রেন। সাধারণত, এই ভ্যাকসিনটি খুব কম বয়সে অথবা বয়ঃসন্ধিকালে নিয়ে নেওয়াই উচিত, কারণ এটা বিশ্বাস করা হয় যে কোনোরকম যৌন মিলন শুরু হওয়ার আগেই এই ভ্যাকসিনটি বেশী কার্যকরী। যদিও, যেসব মহিলারা 45 বছর বয়স অবধি ভ্যাকসিন নেয়নি তারা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে ভ্যাকসিনটি নিতে পারে।
- নিরাপদভাবে যৌনমিলন
যৌন মিলনের সময় HPV সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর জন্য কনডম ব্যবহার করা উচিত। অল্প বয়সে যৌনমিলন এবং একাধিক সঙ্গীর সাথে যৌনমিলন না করলে HPV সংক্রমণ যতটা সম্ভব এড়ানো যায়।
- ধূমপান থেকে বিরত থাকুন
ধূমপান থেকে না করলে তা শুধুমাত্র সার্ভিকাল ক্যানসার প্রতিরোধ করে তা নয় এতে পুরো শরীর ভালো থাকে। যেসব মহিলারা ধূমপান করে তাদের HPV সংক্রমণ এবং সার্ভিকাল ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেশী।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় টেস্ট করালে, সমস্যাগুলি একদম প্রাথমিক স্তরে ধরা পড়ে যায়। সার্ভিকাল ক্যানসার প্রাথমিক স্তরে সহজেই নিরাময় করা যায়। সেইজন্য নিয়মিত পরীক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সার্ভিকাল ক্যানসারের চিকিৎসার বিকল্পগুলি
সার্ভিকাল ক্যানসারের চিকিৎসা নির্ভর করে, এ কোন পর্যায়ে আছে, রোগের ধরণ এবং রোগীর স্বাস্থ্যের ওপর। প্রধান পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলঃ
- সার্জারি
সার্ভিকাল ক্যানসার নিরাময়ের জন্য সার্জারি হল সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা। বিভিন্নধরনের সার্জারি রয়েছে। যেমন:
- কোনিজেশান: সার্ভিক্সের সরু সামনের দিকের অংশকে সরিয়ে ফেলা।
- হিস্তারেকটমি: ইউটেরাস এবং সার্ভিক্স সরিয়ে দেওয়া।
- পেলভিক লিম্ফ নড ডাইসেকশান: উরু থেকে লিম্ফ নডগুলি সরিয়ে দেওয়া
- রেডিয়েশান থেরাপি
রেডিয়েশান থেরাপিতে, উচ্চশক্তি সম্পন্ন রে ব্যবহৃত হয়, যা ক্যানসারের কোশগুলিকে মেরে ফেলতে সাহায্য করে। এটি সাধারণত সার্ভিকাল ক্যানসারের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় অথবা যদি কোনো রোগী অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতার কারণে সার্জারি করাতে না পারেন তাকে এই থেরাপি দেওয়া হয়।
- কেমোথেরাপি
কেমোথেরাপিতে, ক্যানসারের কোশগুলি ওষুধের সাহায্যেই মেরে ফেলা যায়। এটি সাধারণত চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা সার্ভিকাল ক্যানসার আক্রান্ত রোগীকে দেওয়া হয় অথবা শরীরের অন্যান্য অংশে যাতে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়তে না পারে তার জন্য ব্যবহার করা হয়।
- টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি
টার্গেটেড থেরাপি যে অণুজীবগুলি ক্যানসার তৈরি করে তাকে লক্ষ্য করে, আর ইমিউনোথেরাপি শরীরের ইমিউন সিস্টেম বাড়িয়ে দেয় যাতে সহজেই ক্যানসার কোশের সাথে লড়াই করতে পারে।
সার্ভিকাল ক্যানসার সম্পর্কিত প্রচলিত কথা ও তথ্য
প্রচলিত কথা | যুক্তি |
মেনোপসের পর প্যাপ স্মিয়ার টেস্টের প্রয়োজন নেই | মেনোপসের পর এই স্ক্রিনিং খুবই প্রভাবশালী |
শুধুমাত্র বয়স্ক মহিলাদেরই সার্ভিকাল ক্যানসার হয় | সার্ভিকাল ক্যানসার যে কোনো বয়সের মহিলাদেরই হতে পারে। যদিও, বয়সের সাথে সাথে বিপদের সম্ভাবনা বেড়ে যায় |
HPV ভ্যাকসিন শুধুমাত্র যৌনমিলনে সক্রিয় মহিলাদের জন্যই প্রযোজ্য | HPV সংক্রমণের আগে এই ভ্যাকসিন বেশী কার্যকরী |
সার্ভিকাল ক্যানসার সর্বদা মারাত্মক | সময়মত চিকিৎসা করা হলে সার্ভিকাল ক্যানসার নিরাময় সম্ভব |
সিদ্ধান্ত
সার্ভিকাল ক্যানসার খুবই বড় সমস্যা ঠিকই, কিন্তু এই ক্যানসারের নিরাময় সম্ভব। নিয়মিত চেক-আপ, সময়মত HPV ভ্যাকসিন নেওয়া এবং সঠিক জীবনযাপনের মাধ্যমে সার্ভিকাল ক্যানসার অনেকটা নিরাময় সম্ভব। এই সম্পর্কে সঠিক সচেতনতা, প্রাথমিক স্তরেই রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসা এই রোগের সাথে লড়াই করার প্রধান উপাদেয়।