মেনোপজে সুস্থ থাকার উপায়
- Published on March 23, 2023

পঞ্চাশের দোরগোড়ায় এসে হঠাৎই মেজাজটা খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে? রাতে ঘুমের মধ্যে ঘামে ভিজে উঠছে শরীর? জরুরি কথা ভুলে যাচ্ছেন কিংবা কাজে আর এনার্জি পাচ্ছেন না? এই সব লক্ষ্মণের সঙ্গে মাসিক ঋতুস্রাবও যদি অনিয়মিত হয় বা কমে আসে তাহলে ধরে নিতে হবে আপনি মেনোপজের দিকে এগোচ্ছেন।
Table of Contents
মেনোপজ কাকে বলে?
মেনোপজ হল নারীদের জীবনচক্রের এমন একটা সময়, যখন মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায় চিরকালের মতো এবং সেই সঙ্গে সন্তানধারণের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। মোটামুটি ভাবে ৪৫ থেকে ৫৫-র কোঠায় থাকা কোনও মহিলার টানা এক বছর বা তার বেশি সময় ঋতুস্রাব বন্ধ থাকলে ঋতুবন্ধ বা মেনোপজ হয়েছে বলা যায়। এটি একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া। মেনোপজের তিনটে পর্যায় –পেরিমেনোপজ (আগে), মেনোপজ ও পোস্টমেনোপজ (পরে)।
মেনোপজের কারণ?
- বয়স- প্রত্যেক নারীই নির্দিষ্ট সংখ্যার ডিম্বাণু নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। রজস্বলা হওয়ার পর প্রতি মাসে একটা-একটা করে ডিম ফোটে আর ঋতুস্রাবের সময় বেরিয়ে যায় শরীর থেকে। এই কারণে মহিলাদের বয়স যত বাড়ে, ততই শরীরে ডিমের সংখ্যা কমে আসে। এই ভাবে ডিম কমতে কমতে একসময় ডিম্বাশয় সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। যে ইস্ট্রোজেন আর প্রোজেস্টেরন ঋতুস্রাব নিয়ন্ত্রণ করত এতদিন, তা উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায় ডিম্বাশয়ে। শেষ হয়ে যায় ঋতুস্রাব চক্র। পরিসংখ্যান বলছে, ৮৫ শতাংশ মহিলার মেনোপজ হয় ৪৭-৫৪ বছরের মধ্যে। ৪০ বছরের নীচে মেনোপজ হওয়ার সংখ্যাটা ২ শতাংশের মতো। আর ৪০-৪৫ বছরের মধ্যে মেনোপজ হয় ৫ শতাংশ মহিলার। ৫৫-৫৮ বছরে মেনোপজ হওয়ার হারও ৫ শতাংশ। মেনোপজের গড় বয়স আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ৫১, রাশিয়ায় ৫০, গ্রীসে ৪৯, তুরস্ক, ইজিপ্টে ৪৭, ভারতে ৪৬। মেনোপজের লক্ষ্মণগুলো শুরু হওয়া থেকে মেনোপজ হতে অর্থাৎ পেরিমেনোপজ দশা মোটামুটি ভাবে ৩-৪ বছর ধরে চলে। ক্ষেত্রবিশেষে এটা ৫-১৪ বছর পর্যন্ত চলতে পারে।
- প্রাইমারি ওভারিয়ান ইনসাফিশিয়েন্সি- অনেক সময় ৪০ এর আগেই ডিম্বাশয় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তখন সময়ের আগে মেনোপজ হয়ে যায়, যাকে বলে প্রিম্যাচিওর মেনোপজ। নানা কারণে এটা হতে পারে। এখনও পর্যন্ত এর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। থাইরয়েড, ডায়াবেটিসের অস্বাভাবিকত্ব থেকে এটা হতে পারে আবার কেমোথেরাপি, রেডিয়েশনের প্রভাবে হতে পারে বা জিনগত কারণেও হতে পারে। আইডেন্টিকাল টুইনস বা হুবহু যমজদের ক্ষেত্রে প্রিম্যাচিওর মেনোপজের হার ৫ শতাংশ। প্রিম্যাচিওর মেনোপজে চিকিৎসকেরা হরমোন থেরাপির পরামর্শ দিয়ে থাকেন যাতে স্বাভাবিক সময়ের আগে মেনোপজ হয়ে যাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে শরীরের অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গে।
- সার্জিক্যাল মেনোপজ- কোনও শারীরিক জটিলতার কারণে মহিলার শরীর থেকে ডিম্বাশয় কেটে বাদ দিলে (উফোরেক্টোমি) তৎক্ষণাৎ মেনোপজ শুরু হয়ে যায়। আর ঋতুস্রাব হয় না তখন। আচমকা হরমোন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে শারীরিক ও মানসিক জগতে জোর ধাক্কা লাগে। হিস্টেরেক্টোমি অর্থাৎ জরায়ু কেটে বাদ দিলে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মেনোপজ হয় না। এক্ষেত্রে মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেলেও ডিম্বাশয় ডিম নিঃসরণ করে এবং ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন উৎপাদন চলতে থাকে। তবে এক্ষেত্রে মেনোপজের সময় এগিয়ে আসে।
- কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন- ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য মেনোপজ হতে পারে সময়ের আগে। ডিম্বাশয়ে রেডিয়েশন চললে তার কার্যকারিতা শেষ হয়ে যায় এবং মেনোপজ চলে আসে। তবে, শরীরের অন্য অংশে রেডিয়েশন চললে তার প্রভাব পড়ে না ঋতুবন্ধে।
মেনোপজের লক্ষ্মণ
মেনোপজ আসার বেশ কিছুটা আগে থেকেই শরীরকে জানান দেয়, যে সময় এগিয়ে আসছে। তবে, লক্ষ্মণগুলো সবার এক হয় না। এক এক জনের এক এক রকম, কারও বেশি, কারও কম।
মোটামুটি ভাবে অনিয়মিত ঋতুস্রাব একেবারে প্রাথমিক ও স্বাভাবিক লক্ষ্মণ বলা চলে। কখনও এক দু’মাস বন্ধ থাকার পর আবার ঋতুস্রাব শুরু হয়। দ্বিতীয় প্রধান উপসর্গ হল হট ফ্লাশ, যা ৩০ সেকেন্ড থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। সঙ্গে কাঁপুনি ও ঘাম দেয়। মেনোপজের আগে-পরে প্রায় ৪-৫ বছর পর্যন্ত এটা চলতে পারে। এছাড়াও মেনোপজের সময় অনেকের ঘুম কমে যায় বা বারবার ঘুম ভেঙে যায়। মন কখনও ভাল তো কখনও খারাপ, যাকে বলে মুড সুইং হয়। অনেকের এই সময় ওজন বেড়ে যায়। মেটাবলিজম কমে যাওয়ার জন্য এটা হয়ে থাকে। এই সময় চুল পড়তে পারে, ত্বক খসখসে শুকনো হয়ে আসে। যোনিদেশে শুষ্কভাব ও ইনফেকশনের প্রবণতা বাড়ে। মেনোপজের অন্যান্য লক্ষ্মণগুলির মধ্যে রয়েছে গাঁটে ব্যাথা, পিঠে ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, বুক ধড়ফড় ভাব ইত্যাদি।
মেনোপজের ক্ষতিকর প্রভাব
মেনোপজ স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া হলেও শরীরে যথেষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় হাড়ের। মেনোপজের পর পর হাড়ের ডেনসিটি কমতে থাকে দ্রুত, যার ফলে অস্টিওপোরোসিসের সম্ভাবনা বাড়ে। ইস্ট্রোজেন লেভেল কমে গেলে হার্টের রোগ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া মেয়েদের যোনিদেশে আর্দ্রতা বজায় রাথা ও স্থিতিস্থাপকতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বরূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইস্ট্রোজন। শরীরে এই হরমোনের মাত্রা কমতে শুরু করলে যোনিদেশে আর্দ্রতা কমে গিয়ে শুষ্ক ভাব আসে। ল্যাক্টোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিযার পরিমাণ কমে যাওয়ায় খারাপ ব্যাকটেরিয়া প্রভাব বিস্তার করে। ফলে সংক্রমণ হয়। পাশাপাশি মূত্রথলির পেশিও দুর্বল হয়ে যায় বলে প্রস্রাব ধরে রাখতে সমস্যা হয়। যোনিদেশে আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে যৌনজীবনে সমস্যা হয়।
শরীরের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে মেনোপজ। উদ্বেগ, অবসাদের মতো মানসিক সমস্যাগুলো বাড়তে থাকে। স্মৃতিভ্রংশের সমস্যা হয় অনেকের। ব্রেনে ইস্ট্রোজেন লেভেল কমে যাওয়ার জন্য কিংবা হট ফ্লাশের সময় ব্রেনে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়া থেকে এই সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সুস্থ থাকার উপায়
মেনোপজের কোনও চিকিৎসা হয় না, কারণ এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে মেনোপজের কারণে যে সমস্যাগুলো হয় শরীরে, তা কমাতে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু চিকিৎসা ও উপায় আছে।
- হরমোন থেরাপি- মেনোপজের সময় ইস্ট্রোজেন হরমোন থেরাপি করে উপকার পাওয়া যায়। ইউটেরাস ঠিক থাকলে এর সঙ্গে প্রোজেস্টোজেন দেওয়া হয়। ইস্ট্রোজেন হাড়ের ক্ষয় রোধ করে। বেশি সময়ের জন্য এই হরমোন নিলে কার্ডিভাসকুলার সংক্রান্ত রোগ বা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি থাকলেও কম সময়ে ওবং কম মাত্রায় প্রয়োগে লাভ হয়। বিশেষ করে যাদের হট ফ্লাশের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য। এর সঙ্গে টেস্টেস্টেরন থেরাপি করলে যৌনজীবনে উপকার মেলে।
- অন্যান্য ওষুধ-শারীরিক সমস্যার কারণে যাঁরা ইস্ট্রোজেন থেরাপি করতে পারেন না, তাঁরা হট ফ্লাশ এড়াতে গাবাপেনটিন নিতে পারেন। ক্লোনিডাইন নিয়েও উপকার পাওয়া যায়। তবে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও ওষুধই নেওয়া যাবে না। এছাড়া কম মাত্রায় অ্যান্টি ডিপ্রেশনের ওষুধ (সিলেকটিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটরস বা এসএসআরআইজ) নিলেও হট ফ্লাশের সমস্যা এড়ানো যায়। আর হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে অনেক ওষুধই রয়েছে। ক্যালশিয়াম, ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নিলে হাড়ের শক্তি বাড়ে।
- ইস্ট্রোজন ক্রিম- যোনিদেশের আর্দ্রতা ধরে রাখতে ইস্ট্রোজন বাইরে থেকে ক্রিম, ট্যাবলেট বা রিংয়ের মাধ্যমে লাগানো যায়। লুব্রিক্যান্ট বা ময়শ্চারাইজারও ব্যবহার করে উপকার মেলে।
- সুস্থ জীবনযাত্রা- হট ফ্লাশের প্রভাব এড়াতে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে হবে। ঠান্ডা জল খাওয়া, ঠান্ডা ঘরে থাকা ইত্যাদি অভ্যাসগুলো উপকার দেয়। ক্যাফিন এবং মশলাদার খাবার কম খাওয়া ভাল। স্ট্রেস কমাতে হবে। মদ্যপান, ধূমপানের অভ্যাস থাকলে হট ফ্লাশ বেশি হয়। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার আর পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম দরকার শরীরে। প্রাণায়াম করে ভাল ফল মেলে। পেলভিক ফ্লোর পেশী শক্ত করতে নির্দিষ্ট ব্যায়াম রয়েছে, যেগুলি নিয়মিত অভ্যাস করলে উপকার মেলে।
- ফাইটোইস্ট্রোজেন- সোয়াবিন, ডাল, ফ্ল্যাক্সসিড, ও কিছু ফল সব্জিতে ফাইটোইস্ট্রোজেন পাওয়া যায়, যা খেলে মেনোপজের উপসর্গগুলি নিয়ন্ত্রণ করা যায় বলে একটা মত রয়েছে। যদিও এই তথ্য বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত নয় এখনও।
পরিশেষে বলা ভাল, মেনোপজ মানেই জীবন শেষ নয়। বরং এখান থেকে শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়। স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিয় এই প্রক্রিয়াটিকে মেনে নিয়ে সেই অধ্যায়টি সুস্থসম্মত ভাবে উপভোগ করার চাবিকাঠি কিন্তু রয়েছে নিজের হাতেই।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
১) মেনোপজের সময় কী খাবার খাওয়া ভাল?
মেনোপজের উপসর্গগুলি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নজর দিতে হবে ডায়েট চার্টে। ইস্ট্রোজেন কমে যাওয়ার ফলে হাড়ের যে ক্ষতি হয় তা রোধ করতে দুগ্ধজাতীয় খাবার, যেমন দুধ, দই, চিজ খেলে ভাল। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার (সামুদ্রিক মাছ, ফ্ল্যাক্স সিডস, চিয়া সিডস) খেলে হট ফ্লাশ কম হয়। বিভিন্ন শাকসব্জি বিশেষ করে ব্রকোলি ও ফুলকপি ডায়েট চার্টে রাখুন এই সময়। ফাইটোইস্ট্রোজেন সমৃদ্ধ খাবার যেমন সোয়াবিন, বাদাম, আঙুর, বেরিজ, ফ্ল্যাক্স সিডস ইত্যাদি খেলে উপকার হয়। আর অতি অবশ্য প্রোটিন যুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে। প্রসেসড ফুড, ভাত, পাস্তা, আলুর মতো রিফাইনড কার্বোহাইড্রেটস, অ্যালকোহল ও মশলাদার খাবার থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা ভাল।
২) পুরুষদেরও কি মেনোপজ হয়?
শুধু মহিলারাই নন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের শরীরেও টেস্টোস্টেরন ক্ষরণ ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং একটা সময় পুরুষদের জীবনেও মেনোপজ আসে, যাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয় অ্যান্ড্রোপজ। তবে মেনোপজের পর মহিলাদের ডিম্বাশয় সম্পূর্ণ ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও অ্যান্ড্রোপজের ক্ষেত্রে তা হয় না। অল্প মাত্রায় হলেও টেস্টোস্টেরন তৈরি হয় শরীরে। তাই মেনোপজের পর মহিলারা মা না হতে পারলেও পুরুষদের ক্ষেত্রে অ্যান্ড্রোপজের পরেও বাবা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদিও শুক্রাণুর মান তখন ভাল না থাকায় সন্তানের অনেক জটিলতা আসতে পারে।
Related Posts
Written by:
Dr Shreya Gupta
Our Services
Fertility Treatments
Problems with fertility are both emotionally and medically challenging. At Birla Fertility & IVF, we focus on providing you with supportive, personalized care at every step of your journey towards becoming a parent.Male Infertility
Male factor infertility accounts for almost 40%-50% of all infertility cases. Decreased sperm function can be the result of genetic, lifestyle, medical or environmental factors. Fortunately, most causes of male factor infertility can be easily diagnosed and treated.We offer a comprehensive range of sperm retrieval procedures and treatments for couples with male factor infertility or sexual dysfunction.