কম দুর্ভোগে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি (Laparoscopic Surgery in Bengali)
- Published on February 03, 2023

ফালা করে পেট কাটার দরকার নেই। অপারেশন মানেই লম্বা ছুটি আর দুর্ভোগ, এমন ধারণাও অতীত হতে চলল বলে। ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিতে এক বা একাধিক ছোট ফুটো করে শরীরের ভিতরের জটিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অস্ত্রোপচার করা সম্ভব আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে। অল্প একটু কাটা হয় বলে এক্ষেত্রে ব্যথা কম হয়, ধকল কম থাকে, তাড়াতাড়ি সুস্থ জীবনে ফিরে আসা যায়। বিশেষ করে স্ত্রীরোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কোপির গুরুত্ব অপরীসীম। স্ত্রী জননাঙ্গকে অটুট রেখে প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করা যায় ল্যাপারোস্কোপ-এর সাহায্যে। তাই সন্তানধারণে অক্ষমতার সমস্যা সমাধানে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে।
Table of Contents
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির অর্থ কী?
ল্যাপারো কথার অর্থ হল পেট। ল্যাপারোটোমি বলতে বোঝায় পেট কেটে অস্ত্রোপচারকে। চিরাচরিত পদ্ধতিতে একটি উন্মুক্ত অস্ত্রোপচারের (ওপেন সার্জারি) জন্য ৬-১২ ইঞ্চি পেট কাটার দরকার হয় ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি কী অবস্থায় রয়েছে তা জানার জন্য। কিন্তু ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারিতে অতটা পেট কাটার দরকার হয় না। শরীরে আধ ইঞ্চি বা তার থেকেও ছোট দুই-চারটি ফুটো করলেই চলে।
দুরূহ এই কাজটি সম্ভব হয় ল্যাপারোস্কোপ নামে বিশেষ একটি যন্ত্রের জন্য। ল্যাপারোস্কোপে সরু একটি নালী বা টিউবের একমুখে ছোট্ট ক্যামেরা ও টর্চ লাগানো থাকে। ওই যন্ত্র পেটের ভিতরে ঢুকিয়ে মনিটরে ছবি দেখে অস্ত্রোপচার করা হয়। যে শল্যযন্ত্র দিয়ে অস্ত্রোপচার, সেটিও নালীর সাহায্যে শরীরের ভিতরে ঢোকানো হয়। কখনও একটি ছিদ্র দিয়েই ক্যামেরা ও শল্যযন্ত্র প্রবেশ করানো হয়। তবে অধিকাংশ সময় দু’টি বা তিনটি ফুটো করে আলাদা ভাবে ক্যামেরা ও শল্যযন্ত্র ঢোকানো হয়।
বাংলায় একে বলে উদরবীক্ষণ বা উদরবীক্ষণিক শল্য চিকিৎসা। সাধারণত পেট বা শ্রোণীদেশের (পেলভিক) ভিতরের অস্ত্রোপচারগুলি এই পদ্ধতিতে করা হয়। বুকে বা বক্ষদেশে এই প্রযুক্তিতে অস্ত্রোপচারকে বলে বক্ষবীক্ষণিক শল্য চিকিৎসা বা থোরাকোস্কোপিক সার্জারি। হাঁটুর কাছে এই পদ্ধতিতে যে অস্ত্রোপচার হয় তাকে বলে অর্থোস্কোপ।
ছোট ফুটো করে এই অস্ত্রোপচার করা হয় বলে এর আর এক নাম কি-হোল এন্ডোস্কোপিক সার্জারি। মিনিমাল ইনভেসিভ সার্জারির বিশেষ এই প্রযুক্তিতে অনেক সময় রোবট হাতের সাহায্য নেওয়া হয়। একে বলে রোবটিক সার্জারি।
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন কারা
ল্যাপারোস্কোপিক পদ্ধতিতে যাঁরা অস্ত্রোপচার করেন, তাঁদের ল্যাপরোস্কোপিক সার্জন বলে। বাংলায় উদরবীক্ষণিক শল্যবিদ। ল্যাপারোস্কোপ পরিচালনা করার জন্য বিশেষ ট্রেনিং ও দক্ষতা থাকা দরকার। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান যে ভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে আগামী দিনে এই পদ্ধতি না জানলে কোনও অস্ত্রোপচারই করা যাবে কি না সন্দেহ। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভাল, ১৯০১ সালে জার্মান শল্য চিকিৎসক গেয়র্গ কেলিং প্রথম ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করেছিলেন।
কেন-কখন ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করা হয়?
শুধুমাত্র অস্ত্রোপচারের জন্য নয়, রোগ নির্ণয়েও ল্যাপারোস্কোপির সাহায্য নেওয়া হয়। অনেকসময় সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করে সমস্যা চিহ্নিত করা যায় না। পিআইডি (পেলভিক ইনফ্ল্যামাটোরি ডিসিজ) অর্থাৎ মহিলাদের জরায়ু, ডিম্বাশয় বা ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়েছে কি না জানতে বা এন্ডোমেট্রিওসিস, এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি, সিস্ট, ফাইব্রয়েডের উপস্থিতি নির্ণয়ে ল্যাপরোস্কোপি পদ্ধতির সাহায্য নিতে হতে পারে। সন্তানধারণে অক্ষমতার কারণ নির্ণয়ে এই পদ্ধতি কাজে আসে।
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করা হয় পেট ও শ্রোণীদেশে (পেলভিক)। শুরুতে এই পদ্ধতির সাহায্যে গলবাল্ডার অপারেশন করা হত। পরে পেটের আরও সব সমস্যায় এই সার্জারির সাহায্য নেওয়া শুরু হল। যে যে ক্ষেত্রে এখন ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করা হয়, সেগুলি হল—
১) স্ত্রী জননঅঙ্গ থেকে সিস্ট, ফাইব্রয়েড বা পলিপ বাদ দেওয়া,
২) ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লক বা বাধা দূর করা,
৩) ইকোপ্টিক প্রেগন্যান্সি-র ক্ষেত্রে ফ্যালোপিয়ান টিউব থেকে ভ্রূণ নিষ্কাশন,
৪) এন্ডোমেট্রিওসিস সার্জারি,
৫) বায়োপ্সি,
৬) হার্নিয়া সারানো,
৭) গ্যাসট্রিক বাইপাস সার্জারি,
৮) অ্যাপেন্ডিক্স সার্জারি,
৯) পেটে আলসার সারানো,
১০) ওজন কমানোর জন্য অস্ত্রোপচার,
১১) রেক্টাম, ব্লাডার, প্রোস্টেট, কিডনি, অ্যাড্রিনাল গ্রন্থী ইত্যাদি বাদ দেওয়া,
১২) প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারের ক্ষেত্রে টিউমার বাদ দেওয়া,
১৩) হিস্টোরোক্টোমি বা জরায়ু কেটে বাদ,
১৪) ফান্ডোপ্লিকেশন,
১৫) ইউরেথ্রাল অ্যান্ড ভ্যাজাইনাল রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি,
১৬) অর্কিওপেক্সি বা শুক্রাশয়ের সমস্যা ঠিক করা,
১৭) রেক্টোপোক্সি,
১৮) স্প্লিনেক্টোমি,
১৯) লিভার রিসেকশন,
২০) বাওয়েল রিসেকশন বা কোলেক্টোমি ইত্যাদি।
আবার কিছু ক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করা যায় না। যেমন, আগে কোনও জায়গায় অস্ত্রোপচার হলে সেখানে আর ল্যাপারোস্কোপি করার ঝুঁকি নেওয়া যায় না। অস্ত্রোপচারের জায়গায় খুব বেশি মাংস থাকলে মনিটর করতে অসুবিধা হয়। কোথাও ইনফেকশন বা রক্তপাত হলে সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতির সাহায্য না নিয়ে উন্মুক্ত অস্ত্রোপচার করা ভাল। আর রোগীর কার্ডিওপালমোনারি কন্ডিশন থাকলে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় না।
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির প্রস্তুতি
অ্যানাস্থেশিয়ার কাজ ঠিকভাবে যাতে হয় তার জন্য খালি পেটে থাকতে হবে অস্ত্রোপচারের আগে। এই জন্য ৮-১২ ঘণ্টা আগে থেকে কোনও খাবার বা জল খেতে বারণ করেন চিকিৎসকেরা। রক্ত পাতলা করার ওষুধ খেলে তা বন্ধ রাখতে বলা হয় কয়েকদিন।
অস্ত্রোপচারের দিন শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা জানতে সাধারণ কিছু পরীক্ষা করে নেন (ভাইটাল সাইনস) স্বাস্থ্যকর্মীরা। এছাড়াও কিছু রক্ত পরীক্ষা করা হতে পারে এবং অস্ত্রোপচারের জায়গার ইমেজিং টেস্ট হতে পারে। এগুলো হয়ে যাওয়ার পরে ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) নিয়ে যাওয়া হয়। হাতে একটা চ্যানেল তৈরি করা হয় অ্যানাস্থেশিয়ার জন্য। অচেতন থাকার সময় শ্বাস নিতে যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্য অনেকসময় শ্বাসনালীতে একটা আলাদা টিউব ঢোকানো হয়।
ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি পদ্ধতি
শুরুতে কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস ঢুকিয়ে পেট ফোলানো হয় যাতে পেটের চামড়া (অ্যাবডোমিনাল ওয়াল) থেকে ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা হয়ে জায়গাটা মনিটরিংয়ে সুবিধা হয়। নাভিদেশ বা পেলভিক বোনের কাছে একটা ফুটো করে ট্রোকার ঢোকানো হয় এবং তার ভিতর দিয়ে টিউবের সাহায্যে গ্যাস ঢুকিয়ে পেট ফোলানো হয়। এই কাজটা হয়ে যাওয়ার পর গ্যাস টিউব সরিয়ে নেওয়া হয় এবং সেই ট্রোকারেই এবার ল্যাপারোস্কোপ ঢোকানো হয়। ক্যামেরার সাহায্যে তখন পেটের ভিতরের ছবি মনিটরে দেখতে পান শল্যবিদ। এরপর এক বা একাধিক ফুটো করে সেখানে আলাদা আলাদা ট্রোকার স্থাপন করা হয়। এগুলির ভিতর দিয়ে শল্যযন্ত্র দেহের ভিতরে প্রবেশ করানো হয় এবং মনিটরের সাহায্যে ওই যন্ত্র দিয়ে শল্যবিদ অস্ত্রোপচার করেন।
কিছু ক্ষেত্রে ভিতরের ফ্লুইড বার করে আনার জন্য একটা ছোট টিউবের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক সময় অপারেশনের পরেও কিছুটা সময় এই টিউব রেখে দেওয়া হয়। অপারেশন শেষ হয়ে গেলে গ্যাস বার করে ফুটোগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে আধ থেকে এক ঘণ্টা লাগে।
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি পরবর্তী ধাপ
অস্ত্রপ্রচারের কিছুক্ষণ পর রোগীকে ‘রিকভারি রুমে’ পাঠানো হয়। জ্ঞান ফেরা না পর্যন্ত সেখানে মনিটরিংয়ে থাকে রোগী। জ্ঞান ফিরে এলে যাতে ব্যাথা না হয় তার জন্য ব্যাথা কমানোর ওষুধ দেওয়া হয়।
শরীরের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ঢোকানোর জন্য নার্ভের একটা প্রতিক্রিয়া হয় রোগীর। এতে কাঁধের কাছে হালকা ব্যথা (গ্যাস পেইন) হয়। তবে, এক দুদিনের মধ্যে এই ব্যথা চলে যায়। দিনের দিনই সাধারণত রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কখনও এক রাত রাখা হয়। চিকিৎসেকরা কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তা বলে দেন। ফলো-আপ ভিজিট করতে হয় নিয়মমাফিক।
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির সুবিধা
এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল কাটাকুটি অনেক কম। ফলে কাটার জায়গা জোড়া লাগা বা শোকানো বা সেখানে ইনফেকশনের মতো সমস্যা কম। এছাড়াও যে সুবিধাগুলি রয়েছে, সেগুলি হল-
১) পেট কেটে অপারেশনের তুলনায় এই অপারেশন সম্পন্ন করতে একটু বেশি সময় লাগলেও তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়া যায়। ফলে অপারেশনের পর বেশি দিন সময় নষ্ট হয় না। হাসপাতালে খুব বেশি হলে ১ থেকে ৩ দিন থাকতে হতে পারে। তা-ও কোনও জটিলতা থাকলে। ১০ থেকে ১৫ দিনের বিশ্রামের পর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরা যায়।
২) হাসপাতালে বেশি দিন থাকতে হয় না বলে আখেরে উন্মুক্ত অস্ত্রোপচারের থেকে খরচ কম পড়ে।
৩) পেট কাটা হয় না বলে সেলাইয়ের দাগ থাকে না।
৪) এই ধরনের সার্জারিতে বাইরে মনিটরে যে কোনও অঙ্গকে ৪ থেকে ৪০০ গুণ বড় করে দেখা যায় বলে ছোটখাটো ত্রুটি নজর এড়ায় না।
৫) এই পদ্ধতিতে হারমোনিক স্ক্যালপেল, ডায়াথার্মি সিজার্স জাতীয় উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় বলে ব্যাথা বা রক্তপাত কম হয়।
৬) সংক্রমণের সম্ভাবনা কম।
ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া
ল্যাপারোস্কোপির যেমন অনেক সুবিধা আছে, তেমনই এই সার্জারি থেকে ক্ষেত্রবিশেষ কিছু জটিলতাও হতে পারে।
১) সাধারণ সার্জারির মতো এক্ষেত্রেও অ্যানাস্থেশিয়া থেকে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
২) রক্তপাত ও ইনফেকশনের সমস্যা হয় কদাচিৎ।
৩) ল্যাপরোস্কোপির আগে প্রথম যে ট্রোকারটা ঢোকানো হয় শরীর ফুটো করে, সেটা খানিকটা অন্ধের মতো আন্দাজেই করতে হয়। ফলে খুব কম ক্ষেত্রে হলেও এ থেকে ক্ষত হতে পারে।
৪) পেট ফোলানোর জন্য যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস ঢোকানো হয় তা থেকে অনেক সময় শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। নিউমোথোরাক্স বা ফুসফুসে সমস্যা হতে পারে, চামড়ার তলায় বাতাস আটকে থাকে অনেকসময় এবং গ্যাস ঠিক ভাবে গরম না হলে হাইপোথার্মিয়ার সমস্যা হতে পারে।
সব মিলিয়ে এই অস্ত্রোপচারের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া খুবই কম। বেশিরভাগ সমস্যা কয়েকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। তবু জ্বর এলে, বমিভাব হলে বা ব্যাথা যদি ক্রমশ বাড়তে থাকে, রক্তপাত হয়, তখন দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
Related Posts
Written by:
Dr Swati Mishra
Consultant
Dr Swati Mishra is an internationally trained obstetrician-gynecologist and reproductive medicine specialist. She has trained and worked at some of the most reputed medical institutions in India and abroad. She has worked as a visiting consultant at multiple reputed reproductive medicine centers across Kolkata and as a chief consultant in ARC Fertility Center, Kolkata. Her unique skills and diverse work experience in India and the USA have made her a respected name in the field of IVF. She is also a trained specialist in all types of laparoscopic, hysteroscopic and operative procedures related to fertility treatment
Over 18 years of experience
Kolkata, West Bengal
Our Services
Fertility Treatments
Problems with fertility are both emotionally and medically challenging. At Birla Fertility & IVF, we focus on providing you with supportive, personalized care at every step of your journey towards becoming a parent.Male Infertility
Male factor infertility accounts for almost 40%-50% of all infertility cases. Decreased sperm function can be the result of genetic, lifestyle, medical or environmental factors. Fortunately, most causes of male factor infertility can be easily diagnosed and treated.We offer a comprehensive range of sperm retrieval procedures and treatments for couples with male factor infertility or sexual dysfunction.