সন্তানলাভের পথে বড় বাধা পায়োসালপিঙ্কস্

Dr. Prachi Benara
Dr. Prachi Benara

MBBS (Gold Medalist), MS (OBG), DNB (OBG) PG Diploma in Reproductive and Sexual health

16+ Years of experience
সন্তানলাভের পথে বড় বাধা পায়োসালপিঙ্কস্

এককথায় পায়োসালপিঙ্কস্ হল ফ্যালোপিয়ান টিউবে পুঁজ জমে ফোঁড়া।স্ত্রী প্রজননতন্ত্রে ফ্যালোপিয়ান টিউব বা জরায়ুনালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। রজস্বলা হওয়ার পর প্রতি মাসে ডিম্বাশয় থেকে একটি ডিম ফুটে ফ্যালোপিয়ান টিউবে যায়। শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বাণুর মিলনের পর ভ্রূণের সৃষ্টি হয় এই ফ্যালোপিয়ান টিউবেই। তারপর ভ্রূণটি জরায়ুতে গিয়ে বিকশিত হয় সেখানে। এখন কোনও কারণে ফ্যালোপিয়ান টিউবে পুঁজ জমে ফোঁড়ার আকারে ‘ব্লকেজ’ বা বাধা তৈরি হলে (পায়োসালপিঙ্কস্) গর্ভধারণে সমস্যা হয়। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সন্তানধারণে অক্ষম দম্পতিদের মধ্যে প্রায় ২৫-৩৫ শতাংশে ফ্যালোপিয়ান টিউবের সমস্যায় ভোগেন।  

 

পায়োসালপিঙ্কস্ কেন হয়

সাধারণত পিআইডি (পেলভিক ইনফ্ল্যামেটোরি ডিসিজ) বা পেলভিক ইনফেকশনের ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে তা থেকে পায়োসালপিঙ্কস্ হয়। পিআইডি রোগীদের মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশ এই সমস্যার মুখে পড়ে।  পিআইডি হল স্ত্রী জননঅঙ্গে ইনফেকশন বা সংক্রমণ যা মূলত ক্ল্যামিডিয়া, গনোরিয়া ইত্যাদি যৌনবাহিত রোগের কারণে হয়। ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস, টিউবারকুলোসিস থেকেও এই সংক্রমণ হতে পারে। আসলে এই ধরনের সংক্রমণ হলে আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম) শ্বেতকণিকাদের পাঠায় ঘটনাস্থলে। মৃত শ্বেতকণিকাগুলি ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্যে বন্দি হয়ে পড়ে পুঁজের সৃষ্টি করে। ক্রমে এই পুঁজ জমে ফোঁড়ার মতো ফুলে যায় এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবকে ‘ব্লক’ করে দেয়। আশপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সার্জারি, এন্ডোমেট্রিওসিস, টিউব বা সংশ্লিষ্ট প্রজননঅঙ্গে ক্যানসার হলেও তা থেকে পুঁজ জমে পায়োসালপিঙ্কস্ হতে পারে।

 

পায়োসালপিঙ্কস্‌-এর উপসর্গ

বাইরে থেকে কিন্তু এই সমস্যাটা সবসময় বোঝা যায় না। তবে, অনেকেরই তলপেটে ব্যথা হয়, যেটা মাসিক ঋতুস্রাবের আগে বাড়তে পারে। অনেকের তলপেটে ফোলা ভাব দেখা যায়। জ্বর হয় অনেকের, ক্লান্তি ভাব ও গায়ে ব্যথা হয়। যৌনসংসর্গের সময় ব্যথা অনুভূত হওয়াও স্বাভাবিক এই ক্ষেত্রে। অনেকের আবার যোনিস্রাব হয়। তবে, পায়োসালপিঙ্কস্‌-এর সমস্যাটি অধিকাংশ সময়েই সামনে আসে যখন চেষ্টা করেও সন্তানধারণ করতে পারেন না কোনও মহিলা। কারণ গর্ভধারণের জন্য ডিমকে ডিম্বাশয় থেকে ফ্যালোপিয়ান টিউব পর্যন্ত আসতে হবে, যেখানে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলন হবে এবং ভ্রূণ গঠন হবে। ফ্যালোপিয়ান টিউবে বাধা থাকলে ডিম আসতে পারে না বা শুক্রাণুর সঙ্গে মিলন হয় না কিংবা ভ্রূণ তৈরি হলেও অনেকসময় তা আর জরায়ুতে যেতে না পেরে বন্দি হয়ে যায় (একোপ্টিক প্রেগন্যান্সি)। 

 

পায়োসালপিঙ্কস্ নির্ধারণ

সন্তানধারণে অক্ষমতার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে অধিকাংশ সময় পায়োসালপিঙ্কস্ ধরা পড়ে। ফ্যালোপিয়ান টিউব-সহ প্রজনন অঙ্গগুলির পূর্ণ ছবি পেতে চিকিৎসক পেলভিক আলট্রাসাউন্ড করতে বলতে পারেন। ট্রান্সডুসারে বিশেষ একপ্রকার জেল লাগিয়ে পেটের উপর কিংবা যোনি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গের মাধ্যমে ফ্যালোপিয়ান টিউবের ছবি ধরা পড়ে মনিটরে। আবার অনেকসময় পেলভিক এমআরআই করতে বলেন চিকিৎসকেরা। এক্ষেত্রে যন্ত্র সংলগ্ন টেবিলে শুইয়ে দেওয়া হয়। এরপর যন্ত্র থেকে শক্তিশালী রেডিও ও চৌম্বকীয় তরঙ্গ প্রজননঅঙ্গের ছবি তুলে ধরে। নিশ্চিত হতে ল্যাপারোস্কোপিও করা হয়। নাভিদেশ বা পেলভিক বোনের কাছে একটা ফুটো করে ট্রোকার ঢোকানো হয় এবং তার ভিতর দিয়ে টিউবের সাহায্যে কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্যাস ঢুকিয়ে পেট ফোলানো হয়। যাতে পেটের চামড়া (অ্যাবডোমিনাল ওয়াল) থেকে ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা হয়ে জায়গাটা মনিটরিংয়ে সুবিধা হয়। এই কাজটা হয়ে যাওয়ার পর গ্যাস টিউব সরিয়ে নেওয়া হয় এবং সেই ট্রোকারেই এবার ল্যাপারোস্কোপ ঢোকানো হয়। ক্যামেরার সাহায্যে তখন পেটের ভিতরের ছবি মনিটরে দেখতে পান শল্যবিদ। প্রয়োজন মনে হলে এই সময় বায়োপ্সিও করে নেওয়া হয়।

 

পায়োসালপিঙ্কস্‌-এর চিকিৎসা

পিআইডি-র চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকস দেওয়া হয় যাতে সংক্রমণ সেরে যায়। এরই অনুসারী হিসাবে পুঁজ সরে গিয়ে পায়োসালপিঙ্কস্ সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। তবে, সমস্যা যদি গুরুতর হয় তখন শুধু ওষুধে কাজ হয় না। সেক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করা হয়।  ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে ফোঁড়া সমেত পুঁজ সরিয়ে ফেলা যায় ফ্যালোপিয়ান টিউব এবং ডিম্বাশয়ের ক্ষতি না করে। তবে, সমস্যা বেশি হলে দু’টো ফ্যালোপিয়ান টিউবই হয়তো কেটে বাদ দেওয়া হল (বাইল্যাটারাল সালপিঙ্গেক্টোমি)। এই অপারেশনের সঙ্গে অনেকসময় এক বা দু’টো ডিম্বাশয়ও কেটে বাদ দিতে হতে পারে (উফোরেক্টোমি)। সংক্রমণ তবু রয়ে গেলে জরায়ুর কিছুটা অংশ বা সম্পূর্ণ জরায়ু বাদ দিতে হতে পারে (হিস্টেরেক্টোমি) জরায়ুমুখ বা সার্ভিক্স সমেত। ল্যাপারোস্কোপিতেই সমস্যামুক্ত হওয়া গেলে সন্তানধারণের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা যায়। কিন্তু ফ্যালোপিয়ান টিউব, ওভারি বা জরায়ু কেটে বাদ দিতে হলে সন্তানধারণ কঠিন হয়ে পড়ে।

 

পায়োসালপিঙ্কস্ ও সন্তানধারণ

সন্তানধারণে অক্ষমতার অন্যতম কারণ ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লকেজ। সমীক্ষা বলছে সন্তানধারণে অক্ষম দম্পতিদের মধ্যে ২৫-৩৫ শতাংশ ফ্যালোপিয়ান টিউবের সমস্যায় ভোগেন। কারণ গর্ভধারণ প্রক্রিয়ার অনেকটাই এই টিউবের মধ্যে হয়। ডিম্বাশয় থেকে ডিম আসে ফ্যালোপিয়ান টিউবে এবং এখানেই সে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হয়, ভ্রূণের সৃষ্টি হয় ও তারপর জরায়ুতে যায়। ফ্যালোপিয়ান টিউবে পুঁজ জমে বাধার সৃষ্টি হলে এককথায় পায়োসালপিঙ্কস-এর সমস্যা হলে এই প্রক্রিয়াগুলি ব্যাহত হয়। মহিলাদের শরীরে দু’টো ফ্যালোপিয়ান টিউব থাকে। এর মধ্যে একটি খোলা থাকলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে ৫০ শতাংশ। কিন্তু দু’টি টিউবই বন্ধ হয়ে গেলে গর্ভধারণ কঠিন হয়ে যায়। তখন ওষুধ দিয়ে বা ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে টিউবের ব্লকেজ দূর করতে পারলে ভাল। না হলে আইভিএফ-এর (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) সাহায্য নিতে হবে। কারণ ফ্যালোপিয়ান টিউবের কাজগুলি বাইপাস করে আইভিএফ পদ্ধতিতে ভ্রূণের সৃষ্টি ল্যাবরেটরিতেই সম্পন্ন করা হয়। যদিও গবেষণা বলছে পায়োসালপিঙ্কস্-এর চিকিৎসা করার পরে তবেই আইভিএফ শুরু করা উচিত। না হলে গর্ভপাত বা মিসক্যারেজের সম্ভাবনা থাকে। এর কারণ সুনিশ্চিত ভাবে জানা না গেলেও মনে করা হয় টক্সিক পুঁজের খারাপ প্রভাব গিয়ে পড়ে ভ্রূণের উপরে এবং সেখান থেকেই গর্ভপাতের ঝুঁকি আসে। 

  

পরিশেষে বলা যায়, মানবশরীরে প্রজননতন্ত্র যেমন জটিল তেমনই সূক্ষ্ম। তাই কোথাও কোনও সমস্যা মনে হলে চেপে না রেখে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। দেরি হলে অনেকসময়ই সমস্যা গুরুতর আকার নেয়। পায়োসালপিঙ্কস্ যার অন্যতম বড় উদাহরণ। ক্ল্যামিডিয়া, গনোরিয়ার মতো যৌনবাহিত রোগগুলোকে চেপে না রেখে সময়ে তার চিকিৎসা করিয়ে নিলে পায়োসালপিঙ্কস্ পর্যন্ত গড়ায় না সমস্যা। তলপেটে ব্যথা হলে বা যৌনসংসর্গে ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ওষুধ খেয়ে যে সমস্যা মিটিয়ে ফেলা যায় তা অকারণ ফেলে রাখলে পরবর্তীকালে অপারেশন টেবিলে শুতে হতে পারে, এমনকী সন্তানলাভের পথেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই একদিকে যেমন এই নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে জনমনে, অন্য দিকে তেমনই নিজেকে সতর্ক থাকতে হবে।  

    

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

 

১) পায়োসালপিঙ্কস্ কী এসটিডি বা যৌনবাহিত রোগ?

যৌনবাহিত রোগে যে সংক্রমণ হয় ঠিক সময়ে তার চিকিৎসা না হলে ফ্যালোপিয়ান টিউবে পুঁজ জমে পায়োসালপিঙ্কস্ হতে পারে। তাই এটিকে যৌনবাহিত রোগের দীর্ঘমেয়াদী উপসর্গ বলা যেতে পারে।    

 

২) পায়োসালপিঙ্কস্ নিরাময় কি সম্ভব?

এটা নির্ভর করছে ফ্যালোপিয়ান টিউবের অবস্থা কতটা গুরুতর তার উপরে। অধিকাংশ সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক্স নিলে সমস্যা মিটে যায়। কিন্তু পুঁজ জমে ফোঁড়ার মতো উপবৃদ্ধি যদি খুব বেশি হয় তাহলে সার্জারি করতে হতে পারে। ল্যাপারোস্কোপিতে পুঁজ সরিয়ে ফেলা যায়। তাতেও কাজ না হলে অনেকসময ফ্যালোপিয়ান টিউব কেটে বাদ দিতে হয়। সংক্রমণ খুব বেশি ছড়িয়ে পড়লে ডিম্বাশয়, জরায়ু, জরায়ুমুখও কেটে বাদ দিতে হতে পারে।

 

৩) পায়োসালপিঙ্কস্ কি প্রতিরোধ করা যায়?

পায়োসালপিঙ্কস্ প্রতিরোধ করা যায় না, তবে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকলে পেলভিক ইনফেকশন বা পিআইডি হওয়ার ঝুঁকি কম করা যায়। যেমন যৌনসম্পর্কের সময় অবশ্যই কন্ডোম ব্যবহার করতে হবে। বহু যৌনসঙ্গী থাকলে ঝুঁকি বাড়ে পিআইডি-র। সেক্ষেত্রে ক্ল্যামিডিয়া, গনোরিয়ার মতো যৌনবাহিত রোগগুলো রয়েছে কি না তা নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। শুরুতেই জেনে নিলে সময়ের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক্স নেওয়া যায় তখন আর ফ্যালোপিয়ান টিউবের এতটা ক্ষতি হয় না। তাই কোনও কারণে এই ধরনের রোগ হয়েছে অনুমান হলে তা না লুকিয়ে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া উচিত। যোনির পিএইচ মাত্রা ঠিক থাকলে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানো যায়। এর জন্য অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট যুক্ত খাবার খেতে হবে। যোনিদেশ সাবান বা ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শে যেন না আসে। 

 

৪) হাইড্রোসালপিঙ্কস্ কাকে বলে?

গ্রীক শব্দ হাইড্রো-র অর্থ জল আর সালপিঙ্কস্‌ মানে ভেঁপু বা শিঙ্গা। ফ্যালোপিয়ান টিউবে ফ্লুইড (পুঁজ বা রক্ত) জমে ব্লকেজ তৈরি হলে ভিতরটা দেখতে অনেকটা শিঙার মতো হয় বলে এই অবস্থাকে বলে হাইড্রোসালপিঙ্কস্। এটা দুই প্রকারের। রক্ত জমে বাধার সৃষ্টি হলে তাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে হেমাটোসালপিঙ্কস্ আর পুঁজ জমে ব্লকেজ হলে তাকে বলে পায়োসালপিঙ্কস্।

 

৫) পায়োসালপিঙ্কস্‌ হলে কি সন্তানধারণ সম্ভব?

হ্যাঁ, সম্ভব। নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। পায়োসালপিঙ্কস্ নিরাময়ের চিকিৎসা আছে। তাছাড়া ফ্যালোপিয়ান টিউবে সমস্যার ক্ষেত্রে আইভিএফ পদ্ধতি কার্যকরী।

 

৬) পায়োসালপিঙ্কস্ হলে ডিমের গুণগত মানে কি কোনও প্রভাব পড়ে?

পায়োসালপিঙ্কস্ ডিম্বাশয়ের ডিম উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে না। ফ্যালোপিয়ান টিউবে ডিমের আসা বা শুক্রাণুর সঙ্গে মিলনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তবে, যে সংক্রমণের জন্য ফ্যালোপিয়ান টিউবে পুঁজ জমেছে, সেই সংক্রমণ ডিম্বাশয়েরও ক্ষতি করতে পারে ও এতে ডিমের পরিমাণ কমে যেতে পারে।

Our Fertility Specialists