কোনও কারণে পুরুষের লিঙ্গত্বক (ফোরস্কিন) শিশ্নমুণ্ডের (গ্লান্স) পিছনে আটকে গেলে এবং তা কিছুতেই সামনে পুরোটা টেনে নামানো না গেলে যে জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয় তার নাম প্যারাফিমোসিস। অচ্ছিন্নত্বক শিশ্নে (আনসারকামসাইজড পেনিস) এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। লিঙ্গত্বকটি শিশ্নমুণ্ডের পিছনে চেপে আটকে থাকার ফলে শিশ্ন ফুলে যায় এবং রক্ত সঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয়। এটি যথেষ্ট গুরুতর বিষয় এবং এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া দরকার। আশার কথা, চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্যারাফিমোসিসের সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
প্যারাফিমোসিস কী ভাবে হয়
১) কোনও কারণবশত লিঙ্গত্বক অনেকক্ষণ ধরে পিছনে টেনে রাখলে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। স্বাস্থ্যকর্মীদের অসাবধানতাবশত এটা হতে পারে। কোনও শারীরিক পরীক্ষা বা চিকিৎসা পদ্ধতির (যেমন, ক্যাথিটার খোলা-পরা) সময় দীর্ঘক্ষণ লিঙ্গত্বক টেনে ধরে রাখলে কিংবা কাজ শেষে লিঙ্গত্বক পুরোটা টেনে নামাতে ভুলে গেলে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
২) শিশ্নে কোনও সংক্রমণ বা ইনফেকশন থেকেও প্যারাফিমোসিস হতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা, অপরিচ্ছন্নতা থেকে সংক্রমণের সমস্যা হতে পারে।
৩) পুরুষাঙ্গে জোরে আঘাত লাগলে সেখান থেকে ক্ষত বা ফুলে গিয়ে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। পোকার কামড় থেকেও শিশ্ন ও লিঙ্গত্বক ফুলে এটা হতে পারে। ফোলাভাবের জন্য লিঙ্গত্বক নীচে নামানো যায় না।
৪) ডায়াবেটিস রোগীদের শিশ্নে প্রদাহ থেকে প্যারাফিমোসিসের সমস্যা হতে পারে।
৫) অনেকসময় ফোরস্কিন বা লিঙ্গত্বক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আঁটো থাকে। সেক্ষেত্রে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
প্যারাফিমোসিসের লক্ষ্মণ
১) প্যারাফিমোসিসের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্মণ হল লিঙ্গত্বক (ফোরস্কিন) শিশ্নের অগ্রভাগ পর্যন্ত টানতে না পারা।
২) লিঙ্গত্বক ও শিশ্ন ফুলে যায়।
৩) শিশ্নে অস্বস্তি ও ব্যাথা হয়।
৪) ফ্লুইড বা তরল উপাদান ওই অংশে জমতে পারে।
৫) রক্ত সংঞ্চালন ব্যাহত হওয়ার কারণে শিশ্নের অগ্রভাগ বা শিশ্নমুণ্ড কালচে লাল বা বেগুনি রঙের হয়ে যায়। রক্ত সঞ্চালন একেবারে থেমে গেলে শিশ্নমুণ্ড নীল রঙের হয়ে যায়।
৬) মূত্রত্যাগে সমস্যা হতে পারে।
প্যারাফিমোসিস নির্ণয়
এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে বাইরে থেকেই সেটা নজরে আসে। শিশ্নমুণ্ডের পিছনে লিঙ্গত্বকটি শক্ত ব্যান্ডের মতো আটকে থাকে। অনেকসময় অবশ্য আশপাশের অংশ এতটাই ফুলে যায় যে লিঙ্গত্বকের ব্যান্ডটি চাপা পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক অন্যান্য লক্ষ্মণগুলি জিজ্ঞাসা করতে পারেন বা আর কী সমস্যা হচ্ছে সেই সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জরুরি বিভাগে চিকিৎসার জন্য পাঠাবেন। সাধারণত এর জন্য আলাদা করে কোনও পরীক্ষা করার দরকার পড়ে না।
প্যারাফিমোসিস চিকিৎসা
প্যারাফিমোসিস অত্যন্ত গুরুতর একটি অবস্থা যার দ্রুত চিকিৎসা দরকার। না হলে বড় সমস্যা হতে পারে। লিঙ্গত্বক চেপে বসে থাকার জন্য শিশ্নে রক্ত সঞ্চালন কমে যায় এবং এর ফলে শিশ্নমুণ্ডের টিস্যুতে অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি হতে পারে। যেখান থেকে শিশ্নমুণ্ডের টিস্যুর ক্ষতি (ইস্কেমিয়া) বা একেবারে বিনষ্ট (নেক্রোসিস) হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাছাড়া ইনফেকশন থেকেও গ্যাংরিন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে কোনও কারণে লিঙ্গত্বক শিশ্নমুণ্ডের পিছনে আটকে গেলে এবং চেষ্টা করেও তা নামানো না গেলে দ্রুত চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া দরকার।
সাধারণত বয়স এবং পরিস্থিতি কতটা গুরুতর তার উপরে নির্ভর করে প্যারাফিমোসিসের চিকিৎসা হয়।
কমপ্রেসিভ ট্রিটমেন্ট মেথড- প্রাথমিক ভাবে ‘ম্যানুয়ালি’ অর্থাৎ কোনও অস্ত্রোপচার ছাড়াই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। বেশ কয়েকটা উপায়ে এটা করা যায়।
১) হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে চাপ দিয়ে শিশ্নমুণ্ডটি পেছনে ঠেলে লিঙ্গত্বক নীচে নামানোর চেষ্টা করা হয়। সামান্য লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার করা হয় এক্ষেত্রে। বেশি লুব্রিক্যান্ট দিলে আবার পিচ্ছিল হয়ে গিয়ে ধরতে অসুবিধা হতে পারে।
২) ফোলাভাব কমানোর জন্য শিশ্নের চারপাশে প্রথমে গজপ্যাড ও তারপর ১ থেকে ২ ইঞ্চির ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়। ১০ থেকে ২০ মিনিট সেটা রাখা হয়। এতে ফোলা ভাব কমে গেলে আগের পদ্ধতিতেই আঙুলের চাপ দিয়ে একসঙ্গে শিশ্নমুণ্ড ভিতরে ঢোকানো ও লিঙ্গত্বক নীচে টেনে নামানোর চেষ্টা করা হয়।
৩) ফোলাভাব কমানোর জন্য সার্জিকাল গ্লাভসে বরফ ভরে তা চেপে ধরা যেতে পারে শিশ্নে। ফোলাভাব কমলে লিঙ্গত্বকটি টেনে নামানোর চেষ্টা করা হয়। তবে বরফ দেওয়ার জন্য শিশ্নমুণ্ডে রক্ত সংবহন আরও ব্যাহত হতে পারে বলে অনেকেই এই পদ্ধতির সাহায্য না নেওয়ার পরামর্শ দেন।
৪) কমপ্রেসিভ ট্রিটমেন্ট মেথডের আর একটি উপায় হল শিশ্নে ইএমএলএ ক্রিম লাগিয়ে আধ ঘণ্টা রেখে দেওয়া। এটি অনেকটা লোকাল অ্যানাস্থেশিয়ার মতো কাজ করে এবং লিঙ্গত্বকের চামড়া নরম করে।
৫) ফোলাভাব কমানোর আর একটা উপায় হল ইনজেকশনের সাহায্যে সরাসরি লিঙ্গত্বকে ‘হায়ালরনিডেজ’ প্রয়োগ করা।
৬) ২০ শতাংশ ম্যানিটল দ্রবণে গজকাপড় ভিজিয়ে তা ৩৫-৪০ মিনিট শিশ্নের উপর রেখে ফোলাভাব কমানো যেতে পারে।
পাংচার অ্যাসপিরেশন টেকনিক- এই সব কোনও কিছুতে কাজ না হলে ‘পাংচার অ্যাসপিরেশন টেকনিকে’র সাহায্য নেওয়া হয়। ‘হাইপোডারমিক’ সূঁচের সাহায্যে লিঙ্গত্বকে ছোট ছোট ফুটো করে জমা পুঁজ বা রক্ত বার করা হয়। এতে ফোলা ভাব কমে গেলে পর লিঙ্গত্বকটি নামানোর চেষ্টা করা হয়।
সার্জারি- পরিস্থিতি আরও জটিল হলে লিঙ্গত্বক বা ফোরস্কিন ছেদন (ডোরসাল স্লিট) করে শিশ্নমুণ্ডটিকে ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়। অবস্থা বিশেষে লিঙ্গত্বক আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ (সারকামসিশন) করা হতে পারে। এমনিতেও একবার প্যারাফিমোসিস হলে পরে তা আবার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সারকামসিশন করে নিলে ভবিষ্যতে আর এই ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হয় না।
চিকিৎসা পরবর্তী শিশ্নের যত্ন এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। কোনও কারণে জ্বর বা ব্যথা হলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কারণ এই লক্ষ্মণগুলি দেখা দিলে বুঝতে হবে ইনফেকশন হয়েছে। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হবে।
এককথায় বলা যায়, প্যারাফিমোসিস অত্যন্ত জটিল ও গুরুতর একটি পরিস্থিতি হলেও এর চিকিৎসা রয়েছে। এবং, সময় থাকতে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হলে এটি সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা
১) প্যারাফিমোসিস রোধ করার উপায় কী?
প্যারাফিমোসিস থেকে চিরতরে মুক্তির একটিই উপায়- শিশ্নের সম্পূর্ণ ছিন্নত্বকরণ (কমপ্লিট সারকামসিশন)। এছাড়া এই পরিস্থিতি এড়াতে চাইলে যে বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে সেগুলি হল-
১) ক্যাথিটার লাগানো বা এই ধরনের কোনও চিকিৎসা পদ্ধতির পরে ফোরস্কিন বা লিঙ্গত্বক পুরোপুরি টেনে নামানো হয়েছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখা।
২) মূত্রত্যাগ, যৌনসংসর্গ কিংবা লিঙ্গ পরিষ্কার করার প্রয়োজনে লিঙ্গত্বক উপরে টানলে তা নীচে নামানোর বিষয়ে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।
৩) কখনও কোনও কারণেই খুব বেশি সময় ধরে লিঙ্গত্বকটি পিছন দিকে টেনে রাখা উচিত নয়।
৪) স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও নিয়মিত শিশ্নমুণ্ড পরিষ্কার করার অভ্যাস এই রোগ থেকে দূরে রাখে।
২) প্যারাফিমোসিস কি জরুরি অবস্থা?
হ্যাঁ, যত দ্রুত সম্ভব প্যারাফিমোসিসের চিকিৎসা করা দরকার। না হলে লিঙ্গত্বক চেপে বসে থাকার জন্য শিশ্নমুণ্ডে রক্ত সঞ্চালন কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে শিশ্নমুণ্ডে অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতির দরুন টিস্যুর ক্ষতি (ইস্কেমিয়া) বা একেবারে বিনষ্ট (নেক্রোসিস) হওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। তাছাড়া ইনফেকশন থেকেও গ্যাংরিন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে কোনও কারণে লিঙ্গত্বক শিশ্নমুণ্ডের পিছনে আটকে গেলে এবং চেষ্টা করেও তা নামানো না গেলে, দ্রুত চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া দরকার। না হলে চিরতরের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
৩) প্যারাফিমোসিস আর ফাইমোসিসের মধ্যে পার্থক্য কী?
দু’টি সমস্যাই লিঙ্গত্বক বা ফোরস্কিন সম্বন্ধিত। লিঙ্গত্বক শিশ্নমুণ্ডের পিছনে আটকে গেলে এবং তা কিছুতেই সামনে পুরোটা টানা না গেলে যে জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয় তার নাম প্যারাফিমোসিস। আর যখন লিঙ্গত্বকের অগ্রভাগের ছিদ্র এত ছোট থাকে যে সেটাকে শিশ্নমুণ্ডের উপরে টানা যায় না বা সেটা দিয়ে শিশ্নমুণ্ড বার করা যায় না, তখন তাকে বলে ফাইমোসিস। এর মধ্যে প্যারাফিমোসিস তুলনায় অনেকটাই জটিল এবং এর দ্রুত চিকিৎসা করা দরকার। ফাইমোসিস অতটা জরুরি অবস্থা নয়। অল্পবয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত সাধারণ, যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোনওরকম চিকিৎসা ছাড়াই ঠিক হয়ে যায়। আর ঠিক না হলেও এর চিকিৎসা রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। প্যারাফিমোসিস কিন্তু বয়স্কদের বেশি হয়, ছোটদের কম। সমীক্ষা বলছে, অচ্ছিন্নত্বক শিশুদের (১২ বছর বয়স পর্যন্ত) মধ্যে প্যারাফিমোসিস রোগের হার ০.২ শতাংশ। যেখানে ১৬ বা তার থেকে বেশি বয়সীদের মধ্যে এই রোগের হার প্রায় ১ শতাংশ।
৪) প্যারাফিমোসিস কি নিজে থেকে ঠিক হয়ে যেতে পারে?
না, প্যারাফিমোসিস নিজে থেকে ঠিক হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। লিঙ্গত্বক শিশ্নমুণ্ডের উপরে আটকে গেলে এবং তা টেনে না নামানো গেলে কিছু সময় পরে নিজে থেকে নেমে আসার সম্ভাবনা নেই। অযথা সময় নষ্ট না করে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়াই বিবেচকের কাজ।