নারী থেকে মা হওয়ার যাত্রাপথ সহজ নয়। শরীরে ক্লান্তি আসে, মাথা ধরা ভাব, মেজাজ এই ভাল-এই খারাপ, গায়ে-হাতে ব্যথা ইত্যাদি অত্যন্ত সাধারণ উপসর্গ। ইচ্ছা করে শুয়ে-বসে থাকতে। অনেকে তো সামান্য চলাফেরা, নড়াচড়াও বন্ধ করে দেন এই ভয়ে যে সন্তানের যদি কোনও ক্ষতি হয়ে যায়। কিন্তু এই ধারণা সর্বৈব ভুল। শুয়ে বসে থাকলে বরং ক্লান্তি ভাব আরও বাড়ে, শরীরে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়, ওজন বেড়ে যায়। এমনিতেও এই সময় একটু বেশি খিদে পায় বা ভালমন্দ খাওয়ার ইচ্ছা হয় বলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অতিরিক্ত ওজনের কারণে গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের সময়ে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই শুয়ে-বসে না থেকে হবু মায়েরা যদি এই সময়ে হাঁটাচলা ও যোগব্যায়াম করেন, তাহলে শরীর-মন সুস্থ থাকে এবং প্রসবের সময়ও জটিলতা কম হয়।
গর্ভাবস্থায় কেন যোগব্যায়াম করা উচিত
যোগব্যায়ামের অনেক উপকারিতা। গর্ভাবস্থায় যোগব্যায়াম করলে—
১) ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে,
২) শরীরে রক্ত চলাচল বাড়ে,
৩) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে,
৪) শরীরে এনার্জি আসে,
৫) পর্যাপ্ত ঘুম হয়,
৬) দুশ্চিন্তা-অবসাদ-উদ্বেগ কম হয়,
৭) হরমোনের ভারসাম্য ঠিক থাকে,
৮) পেশী দৃঢ় হয় বিশেষ করে পেলভিক মাসলে জোর আসে,
৯) শরীরে নমনীয়তা (ফ্লেক্সিবিসিটি) বাড়ে,
১০) ভারসাম্য (ব্যালান্সিং) ঠিক থাকে,
১১) কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাসের সমস্যা ও বদহজম থেকে মুক্তি মেলে,
১২) শ্বাসবায়ু নিয়ন্ত্রণের অভ্যাসে ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ে।
আসলে, যোগব্যায়াম করলে পিটুইটারি গ্রন্থি ‘মন ভাল করা’ জৈব রাসায়নিক উপাদান এন্ডোমর্ফিন উৎপাদন শুরু করে। এন্ডোমর্ফিন ব্যথা কমায় ও শরীরে ভাল লাগার অনুভূতি আনে বলে এদের ন্যাচারাল পেইন কিলার বলা হয়। ব্যায়ামের পরে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে এন্ডোমর্ফিন দ্রুত হারে শরীরে ছুটে বেড়ায়। ফলে স্ট্রেস বা উদ্বেগ কমে, মনে আনন্দের সঞ্চার হয়। এছাড়া নিয়মিত যোগব্যায়ামে কোষের ইনসুলিন গ্রহীতা বা রিসেপটরের সংখ্যা বাড়ে। ফলে কম ইনসুনিলে কাজ চলে যায় বলে শরীরে বেশি ইউসুলিন উৎপাদন হয় না। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
গর্ভাবস্থায় কোন যোগব্যায়াম অভ্যাস করব
সাধারণত গর্ভাবস্থায় প্রসূতিদের সমতলে হাঁটার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। এছাড়া সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ দিন ২০ মিনিট যোগাসন করতে পারলে ভাল। গর্ভধারণের শুরুর দিকে (ফার্স্ট ট্রিমস্টার) দাঁড়িয়ে থেকে যে যোগব্যায়ামগুলি রয়েছে সেগুলি অভ্যাস করলে উপকার মেলে। এতে অতিরিক্ত ওজন বহনের জন্য শরীরের নিম্নাংশ তৈরি হয়, ব্যালান্স থাকে। সেকেন্ড ট্রিমস্টারে কিছুটা নিশ্চিন্তে ব্যায়াম করা যায়। থার্ড ট্রিমস্টারে আবার শরীরের উপর বেশি চাপ যাতে না পড়ে খেয়াল রাখতে হবে।
এই সময় যে ব্যায়ামগুলি করা যায়, সেগুলি হল-
- মার্জারি আসন- গর্ভাবস্থায় অনেকটা বেশি ওজন সামলাতে হয় শরীরের। ফলে কোমর ও পিঠের উপর চাপ বাড়ে। মার্জারি আসন অভ্যাস করলে কোমর, পিঠ, কাঁধ ও ঘাড়ে ব্যথা ভাব দূর হয়ে আরাম মেলে। শিরদাঁড়াও নমনীয় থাকে। এরই সঙ্গে পেটের পেশীকে দৃঢ় করতে সাহায্য করে আসনটি। রক্ত চলাচল বাড়ে শরীরে।
- ত্রিকোণাসান- ত্রিকোণাসন করলে শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য বজায় থাকে। শরীরের নিম্নাঙ্গ এতে নমনীয় হয়। প্রসবের সময় সুবিধা হয়।
- যোগ নিদ্রা- অনেকেই মনে করেন হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকার এই ভঙ্গি কোনও আসন নয়। কিন্তু বাস্তবে টানটান হয়ে শুয়ে ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি পর্যায়ে পৌঁছনো সহজ কাজও নয়। মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে যোগনিদ্রা। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
- বীরভদ্রাসন- শরীরের ব্যালান্স বাড়াতে সাহায্য করে এই আসন। হাত, পা এবং পিঠের নীচের দিকের পেশী দৃঢ় করতে সাহায্য করে, শরীরের শক্তি বাড়ায়।
- বদ্ধকোণাসন- শরীরের পশ্চাদ্দেশ ও যোনি সংলগ্ন এলাকায় ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ে এই আসনে। ফলে প্রসবে সুবিধা হয়। উরুদেশের পেশী দৃঢ় হয়, হাঁটুর ব্যাথা কমে, গর্ভাবস্থায় যে ক্লান্তি থাকে তা দূর হয়।
- সহজ সেতু আসন- এই আসনটি গর্ভাবস্থার ৬-৭ মাস পর্যন্ত করা যায়। এই সময়ে কোমরে যে ব্যাথা হয় তা থেকে আরাম মেলে এই আসন করলে।
- ব্রহ্মচর্যাসন ও সুপ্ত ব্রহ্মচর্যাসন- এই দুটি আসনই গর্ভাবস্থার শেষ (থার্ড ট্রিমস্টার) পর্যন্ত করা যায়। এটি তলপেট এবং পশ্চাদ্দেশের দৃঢ়তা বাড়াতে সাহায্য করে ফলে প্রসবে সুবিধা হয়।
- বদ্ধ গোমুখাসন- গর্ভাবস্থায় তলপেট ভারী হয়ে যায়। পেট যাতে বেশি নীচে না নেমে যায় এবং টাইট থাকে, তার জন্য এই ব্যায়াম করা হয়।
- অর্ভক আসন ও জয়াসন- এই দু’টি আসন শুধু হবু মা নয়, গর্ভের সন্তানের জন্যও উপকারী।
- অর্ধবিভক্ত আসন- এই আসনে উরুর পেশীর স্ট্রেচিং হয়। এই আসন অভ্যাস করলে ব্যালান্সিং ভাল থাকে, অবসাদ কমে।
- প্রাণায়াম- গর্ভাবস্থায় শরীর ও মনকে প্রফুল্ল রাখতে সবচেয়ে কার্যকরী হল প্রাণায়াম। আমাদের যোগব্যায়ামে নানাধরনের প্রাণায়াম রয়েছে। ভ্রমণ প্রাণায়াম, ভ্রমরী প্রাণায়াম, ব্রাহ্মী প্রাণায়াম ইত্যাদি। সুবিধা মতো যে কোনও একটা প্রাণায়াম নিয়মিত অভ্যাস করলে হরমোন নিঃসরণ ভাল হয়, মায়ের সঙ্গে শিশুর যোগসূত্র গড়ে ওঠে। প্রাণায়ামের মাধ্যমে শ্বাসবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে তা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, শরীরে রক্ত চলাচল বাড়ে। শুধু মা নয়, সন্তানের দেহেও অক্সিজেন সরবরাহ ভাল হয়।
গর্ভাবস্থায় কোন ধরনের ব্যায়াম করা উচিত নয়
বছর দু’য়েক আগে অভিনেত্রী অনুষ্কা শর্মা গর্ভবতী অবস্থায় শীর্ষাসনের ছবি পোস্ট করে শোরগোল ফেলে গিয়েছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রশ্ন ওঠে, আদৌ গর্ভাবস্থায় এই ধরনের ব্যায়াম করা উচিত কি না। অনুষ্কা জানিয়েছিলেন, এই ব্যায়ামটি তিনি দীর্ঘ দিন ধরে করছেন। আর চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেই তিনি এই ব্যায়াম করেছেন এবং এটা করতে তাঁর কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণ লোকজনের গর্ভাবস্থায় শীর্ষাসন করা উচিত নয়। অভিনেতা বা ক্রিড়াবিদদের ফিটনেস অনেক বেশি থাকে। দীর্ঘ দিনের চেষ্টায় তাঁরা শরীরকে এতটাই মজবুত করে তোলেন যে তাঁদের পক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব। সেরিনা ইউলিয়ামস গর্ভাবস্থায় অষ্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছিলেন। এদেঁর দেখে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্ত হওয়ার দরকার নেই। সকলের শরীর এক নয়। মেডিক্যাল হিস্ট্রি অর্থাৎ গর্ভধারণে কোনও জটিলতা আছে কি না, শরীরের অবস্থা কী রকম তা বিচার করেই শরীরচর্চার রুটিন ঠিক করা উচিত। সাধারণ গর্ভাবস্থায় যে যোগব্যায়ামগুলি করা যায় ‘হাই রিস্ক’ প্রসূতিদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। ‘হাই রিস্ক’ বলতে যাদের আগে গর্ভপাত হয়েছে, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তাল্পতা বা ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে তাদের বোঝানো হচ্ছে। প্রসূতি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করতে হবে কী যোগব্যায়াম করা যাবে, কী করা যাবে না। যেমন, তলপেটের উপর চাপ পড়ে এমন আসন এই সময় করা যাবে না। যে আসনগুলি অনেকক্ষণ ধরে রাখার ব্যাপার থাকে, সেগুলি না করা উচিত। ব্যায়ামের সময় শরীর খারাপ লাগলে সঙ্গে সঙ্গে থেমে যেতে হবে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট, পেটে বা বুকে ব্যাথা, পেশীতে টান পড়ছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। ভরা পেটে ব্যায়াম করা যাবে না এবং ব্যায়ামের মাঝে পিপাসা পেলে জল খেতে হবে। সনা যোগা বা হট যোগা করা যাবে না।
যে যোগব্যায়ামগুলি গর্ভাবস্থায় করা বারণ, সেগুলি হল—
১) নৌকাসন
২) চক্রাসন
৩) অর্ধ মৎস্যেন্দ্রাসন
৪) ভূজঙ্গাসন
৫) বিপরীত শলভাসন
৬) হলাসন
সন্তানহীনতার সমস্যা সমাধানে যোগব্যায়াম
সন্তানহীনতার সমস্যার একটা বড় কারণ থাকে ওজন বেশি। এছাড়া আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ আমাদের শরীরে হরমোনের ভারসাম্যের অভাবে নানা রোগ বাসা বাধে। যোগব্যায়াম করে যেমন ওজন নিযন্ত্রণ করা যায় তেমনই শরীরে হরমোনের ভারসাম্যও ঠিক রাখা যায়। এছাড়া যোগব্যায়াম মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগ দূর করে। অনিয়মিত ঋতুস্রাবের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় যোগব্যায়ামে।
সন্তানহীনতার সমস্যায় যে ব্যায়ামগুলি করলে উপকার মেলে সেগুলি হল—
- ভূজঙ্গাসন- মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে হাতের তালু পাঁজরের দু’পাশে রাখতে হবে। হাতের তালুতে ভর দিয়ে শরীরের উপরিভাগ ধীরে ধীরে উপর দিকে তুলে মাথা বেঁকিয়ে উপরের দিকে তাকাতে হবে। কোমর থেকে পা পর্যন্ত মাটিতে ঠেকে থাকবে। ২০-৩০ সেকেন্ড পর আগের অবস্থায় ফিরে আসা যাবে। পেটের মেদ ঝরাতে সাহায্য করে এই আসন।
- ত্রিকোণাসন- প্রথমে পা ফাঁক করে দাঁড়াতে হবে। হাত দুটো দু’পাশে প্রসারিত থাকবে। এবার বাঁ পাশে শরীর বেঁকিয়ে বাঁ হাত দিয়ে বাঁ পায়ের আঙুল স্পর্শ করতে হবে। ডান হাতটা উপরের দিকে একেবারে সোজা থাকবে। হাঁটু ভাঙা চলবে না। কিছুক্ষণ পর হাতগুলো একই রকম প্রসারিত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। একই ভাবে এবার ডান হাত দিয়ে ডান পায়ের আঙুল স্পর্শ করতে হবে। এই আসন হজমের ক্ষমতা বাড়ায়। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে এই আসন করে উপকার পাওয়া যায়। মানসিক অবসাদ কাটাতে সাহায্য করে।
- নৌকাসন- প্রথমে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে হবে। এরপর শ্বাস নিতে নিতে নিতম্ব ও কোমরে ভর দিয়ে দেহের উপরিভাগ ও পা একই সঙ্গে উপর দিকে তুলতে হবে। এরকম নৌকার মতো অবস্থায় দেহটা ২০-৩০ সেকেন্ড থাকবে। তারপর শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে হবে। প্রতি দিন ২-৩ বার এই যোগাসনটি অভ্যাস করলে শরীরের পেশীগুলি শক্তিশালী হবে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
- পশ্চিমোত্তানাসন- পা দু’টো সামনে ছড়িয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসতে হবে। হাত মাথার উপরে তোলা থাকবে। এবার হাত নামিয়ে পায়ের গোড়ালি ধরতে হবে। মাথা ঠেকানো থাকবে হাঁটুতে। কনুই ভেঙে মেঝে স্পর্শ করবে। এই আসন পিঠের নীচের দিক, উরু, পায়ের পেশীর শক্তি বাড়ায়। স্ত্রী জননঅঙ্গগুলিকে রক্ত প্রবাহ বাড়িয়ে এনার্জি বা শক্তি জোগায়।
এছাড়াও সূর্য প্রণাম নিয়মিত অভ্যাস করলে অনিয়মিত ঋতুস্রাব, ও ঋতুস্রাবের সময়ে ব্যাথা দূর হয়, যৌনক্ষমতা বাড়ে। ভ্রমরী প্রাণায়াম, ভ্রমণ প্রাণায়াম বা নাড়িশোধন অভ্যাস করলে শরীরের পাশাপাশি মন ভাল থাকে।