পিসিওএস এবং পিসিওডি-র তফাত জানুন
- Published on March 23, 2023

নামটা প্রায় এক, লক্ষ্মণও উনিশ-বিশ। কিন্তু পিসিওএস আর পিসিওডি যে দু’টো পৃথক শারীরিক সমস্যা, সেটা অনেকেই জানে না এখনও। এমনিতে মহিলাদের ঋতুস্রাব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করায় যথেষ্ট লজ্জা-দ্বিধা রয়েছে আমাদের সমাজে। তার সঙ্গে জড়িত সমস্যাগুলো তাই একঘরে হয়ে পড়ে থাকে। অথচ, পরিসংখ্যান বলছে ভারতে প্রতি পাঁচ জন রজস্বলা মহিলার এক জন পিসিওডি-র সমস্যায় ভোগেন। অনিয়মিত ঋতুস্রাব থেকে শুরু করে ওজন বৃদ্ধি, সন্তানধারণে অক্ষমতার মতো গুরুতর শারীরিক সমস্যাগুলির জন্য দায়ী পিসিওএস আর পিসিওডি। বিষয়টি নিয়ে সচেতনতার অভাব সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। বিশ্বায়নের যুগে আধুনিক জীবনযাত্রার কারণে শরীরে থাবা বসাচ্ছে জটিল এই রোগগুলি। এর থেকে রক্ষা পেতে শরীরচর্চা করে ওজন কমাতে হবে, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, পর্যাপ্ত ঘুম আর রুটিন মেনে চলা জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ হতে হবে। তবে সবার আগে জানতে হবে শারীরিক এই সমস্যাগুলির প্রকৃতি ও কার্যকারণ।
Table of Contents
পিসিওডি কী?
পিসিওডি-র পুরো নাম পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিসিজ। রজস্বলা হওয়ার পর প্রতি মাসে একটা-একটা করে ডিম ফোটে আর ঋতুস্রাবের সময় বেরিয়ে যায় নারী শরীর থেকে। দু’টি ডিম্বাশয় পালা করে প্রত্যেক মাসে একটা করে ডিম ছাড়ে। কিন্তু পিসিওডি-র সমস্যা থাকলে ডিম্বাশয়গুলি থেকে অপরিণত বা অর্ধ পরিণত ডিম নির্গত হয়। এই ডিমগুলো বেরোতে পারে না বলে ডিম্বাশয় ক্রমশ অপরিণত কিংবা অর্ধপরিণত ডিমে ভরে যায়। পরবর্তী সময়ে এগুলি জমে সিস্টে পরিণত হয়। ছোট ছোট টিউমারের আকারে দেখতে এই সিস্টগুলো তরল ও অর্ধতরল উপাদান দিয়ে তৈরি। ৬ মিলিলিটার পর্যন্ত ওজনের হতে পারে সিস্টগুলি। পলি কথার অর্থ অনেক। সিস্টের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ফুলেফেঁপে ডিম্বাশয়ের আকার বেড়ে যায় ক্রমশ। সাধারণ ভাবে আমাদের ডিম্বাশয় খুব অল্প পরিমাণে পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন উৎপাদন করে। কিন্তু পিসিওডি হলে ডিম্বাশয়ে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন উৎপাদন বেড়ে যায়। যার জেরে অনিয়মিত ঋতুস্রাব, শরীরে লোমের আধিক্য, পেটে চর্বি জমা ও ওজন বাড়া, চুল পড়ে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো দেখা দেয়। সেই সঙ্গে সন্তানধারণে অক্ষমতার সমস্যা হয়।
পিসিওডি যেহেতু একটা উপসর্গ, বড় কোনও রোগ নয়, সেহেতু এটার সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে উপকার পাওয়া যায়। যেমন, স্কিপিং, জগিং, দৌড়ানো ও দ্রুত হাঁটাহাঁটির মতো (কার্ডিও) শরীরচর্চা, যোগব্যায়াম, বিশেষ করে পেটের চর্বি কমানোর ব্যায়ামগুলো করলে সুফল মেলে। কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট জাতীয় খাবারের বদলে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার আর ফাইবার যুক্ত ফল, শাকসব্জি বেশি খেতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে হরমোনের ভারসাম্য আনতে ওষুধও দেন চিকিৎসকেরা। কখনও আবার ল্যাপারোস্কোপিক ওভারিয়ান ড্রিলিংয়ের মতো পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়।
পিসিওএস কী
পিসিওএস-এর পুরো কথাটা হল পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম। এটা একটা মেটাবলিক ডিজঅর্ডার, যার জেরে ডিম্বাশয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন উৎপাদন হয়। এই হরমোনের জন্য ডিম ফোটার কাজ ব্যাহত হয় এবং অপরিণত ডিমগুলি সিস্ট হয়ে ওভারিতে জমতে থাকে। পুরো ডিম্বাশয় জুড়ে ধার ঘেঁষে (সারফেসে) ছোট ছোট ফোসকার মতো সিস্টগুলো ছড়িয়ে থাকে। এই ভাবে ডিম্বাশয় ভারী হয়ে যায়। অনিয়মিত ঋতুস্রাব পিসিওএস-এর প্রধান লক্ষ্মণ। পিসিওএস-এর সমস্যা থাকলে দু’টি ঋতুচক্রের মধ্যে সময়ের ব্যবধান বাড়তে থাকে (৩৫ দিন বা তার বেশি)। এই ভাবে দেখা যায় বছরে ১২টার (১২ মাসে) বদলে হয়তো ৯টা ঋতুচক্র সম্পন্ন হল বা তারও কম। পুরুষ হরমোনের আধিক্যের কারণে শরীরে লোমের আধিক্য (হিরসুটিজম) দেখা দেয়। গোঁফের রেখা ওঠে, মুখে ব্রন হয়, চুল পাতলা হয়ে আসে। ওজনও বাড়ে। ঘুমের সময় শ্বাসক্রিয়া ব্যাহত হয়, যার জেরে ঠিক মতো ঘুম হয় না।
কেন পিসিওএস হয়, তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি এখনও। তবে কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে এই সমস্যার পিছনে। যেমন ইনসুলিন প্রতিরোধের কারণে শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন বেড়ে গেলে এই সমস্যা হতে পারে। কারণ ইনসুলিন খুব বেশি উৎপাদন হলে তা পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেনের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। গবেষণা বলছে, জিনগত কারণও এই সমস্যার জন্য দায়ী হতে পারে। তাই যে পরিবারে মা-মাসিদের পিসিএএস-এর সমস্যা রয়েছে সেখানে পরবর্তী প্রজন্মের মেয়েদের এই সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার নজির বেশি।
ডিম ফোটার কাজ ব্যাহত হয় বলে পিসিওএস-এ সন্তানধারণে সমস্যা হয়। এছাড়া গর্ভপাত ও নির্ধারিত সময়ের আগে প্রসবের ঝুঁকিও থাকে পিসিওএস আক্রান্তদের। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা, টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ওভ্যুলেশন হয় না বলে জরায়ুতে ইউটেরাইন লাইনিং জমে জমে এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যানসারের সম্ভাবনা থাকে।
পিসিওএস-এর চিকিৎসা বলতে জন্ম নিরোধক বড়ি যাতে মহিলা হরমোন ইস্ট্রোজেন আর প্রোজেস্টিন (প্রোজেস্টেরনের মতো কাজ করে) থাকায় ঋতুস্রাব স্বাভাবিক করে, এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। ত্বক বা ব্রণর সমস্যার জন্য ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। পিসিওএস থাকলে গর্ভধারণের জন্য ক্লোমিফিন দেন চিকিৎসকেরা। এতেও কাজ না হলে মেটফরমিন (টাইপ টু ডায়াবেটিসের ওষুধ) যোগ করা হয়। ব্রেস্ট ক্যানসারে ব্যবহৃত লেট্রোজোল ডিম্বাশয় উদ্দীপনায় কাজ দেয়। এছাড়া গোনাডোট্রপিনস হরমোন ইনজেকশন দেওয়া হয়। শরীরে লোমের আধিক্য ও ব্রনর সমস্যাতে জন্ম নিরোধক বড়ি কার্যকরী। একই সমস্যায় স্পাইরোনোল্যাকটন নেওয়া যেতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা (ফ্যামিলি প্ল্যানিং) করা যাবে না। এছাড়াও আরও কিছু ওষুধ আছে। কিন্তু এগুলো কোনওটাই রোগ সারানোর ওষুধ নয়, উপসর্গকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় মাত্র। সুস্থ জীবনযাত্রা বরং এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক বেশি কার্যকরী। বিশেষ করে ওজন কমাতে পারলে ভাল ফল মেলে। ব্যায়াম করলে এবং কম কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার খেলে ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
পিসিওএস এবং পিসিওডি-র পার্থক্য
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে দু’টি সমস্যাই মহিলাদের প্রজননতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত এবং প্রজনন ক্ষমতায় প্রভাব ফেলে। দু’টি ক্ষেত্রেই হরমোনের তারতম্য হয় শরীরে। দু’টি সমস্যার উপসর্গগুলোও প্রায় এক এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাত্রা সমস্যা দু’টি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায়। তবে, এই মিলগুলি যেমন আছে, তেমন দু’টির মধ্যে পার্থক্যও অনেক আছে। সেগুলি হল—
- প্রথমত, রোগের মাত্রা। পিসিওএস অত্যন্ত গুরুতর একটা রোগ। পিসিওডি সেই তুলনায় কম গুরুতর। পিসিওডি-কে রোগও বলা চলে না, উপসর্গ বলা ভাল। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, ব্যায়াম, শরীরচর্চা করে পিসিওডি বাগে আনা যায়। বিশেষ করে ওজন কমানোর সঙ্গে এটা কমার সমানুপাতিক একটা সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু পিসিওএস এন্ডোক্রিন সিস্টেমের গোলমালের জন্য হয়। বাইরে থেকে হরমোনাল চিকিৎসা ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণ করা বা বাগে আনা বেশ কঠিন।
- দ্বিতীয়ত, পিসিওডি-র সমস্যা অনেক মহিলারই রয়েছে। সেই তুলনায় পিসিওএস-এ কম ভোগে মহিলারা। দক্ষিণ ভারত ও মহারাষ্ট্রে ইউনিসেফের করা একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, এই এলাকায় রজস্বলা মহিলাদের মধ্যে ৯.১৩ শতাংশ পিসিওএস সমস্যায় ভুগছেন, যেখানে পিসিওডিতে ভোগার সংখ্যাটা ২২.৫ শতাংশ।
- তৃতীয়ত, দু’টি সমস্যাই সন্তানধারণের পথে বাধা। কিন্তু জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে ও সামান্য কিছু ওষুধে পিসিওডি-র সমস্যা অনেকটাই সারিয়ে ফেলা যায় এবং সন্তানধারণ সম্ভব হয়। অন্যদিকে, পিসিওএস-এর সমস্যাটি এতটাই জটিল যে সুস্থ জীবনযাত্রার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা করতে হয় এবং তারপরেও সন্তানলাভের সম্ভাবনা কতটা সুনিশ্চিত করে বলা যায় না। আর গর্ভপাত বা মিসক্যারেজের ঝুঁকিও থাকে এই রোগে।
- চতুর্থত, পিসিওডির সমস্যা হলে হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। অন্যদিকে, হরমোনের অস্বাভাবিকত্বের জন্য পিসিওএস-এর সমস্যা হয়। এই ভাবে এই দু’টি সমস্যার মধ্যে কার্যকারণের বিপরীত একটা সম্পর্ক রযেছে। পিসিওডি হল আদপে একটা উপসর্গ, সেখানে পিসিওএস একটা রোগ।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা
১) পিসিওএস ও পিসিওডি-র সমস্যা নিয়ন্ত্রণে কী খাবার খেতে হবে?
কম কার্বোহাইড্রেট এবং সেই জায়গায় প্রোটিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে। সাধারণ ভাত-রুটির বদলে ব্রাউন রাইস, আটার রুটি, ব্রাউন ব্রেড খাওয়া ভাল। রান্নার মাধ্যম হিসাবে অলিভ, ক্যানোলা, পিনাট বা আমন্ড অয়েল ব্যবহার করা উচিত। শাকসব্জির সঙ্গে ফলমূল খেতে হবে। তবে, আম, কলা, আতা, আঁখ, কাঁঠালের মতো ফলগুলো না খাওয়া ভাল। কুসুম বাদ দিয়ে ডিমের সাদা অংশ, ছোট মাছ ইত্যাদি খেতে পারেন। দুধ খেলে ফ্যাটের পরিমাণ কম আছে এমন খেতে হবে। প্রসেসড খাবার, রেড মিট, ভাজাভুজি থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা ভাল।
২) পিসিওএস ও পিসিওডি কী পুরোপুরি ভাবে সারানো সম্ভব?
না, এই সমস্যাগুলিকে সম্পূর্ণ ভাবে সারিয়ে একেবারে সুস্থ হওয়া সম্ভব নয়। তবে, চেষ্টা করলে এই সমস্যাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় বা কমানো যায়।
৩) মেনোপজের পর কী পিসিওএস-এর থেকে মুক্তি মেলে?
না, মেনোপজের সময় শরীরে হরমোনের অনেক তারতম্য হলেও পিসিওএস সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। বরং পিসিওএস-এর আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলো যেমন, হার্টের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস টাইপ টু ইত্যাদির রিস্ক আরও বাড়তে থাকে। পিসিওএস নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র উপায় সুস্থ জীবনযাত্রা, ব্যায়াম ও হরমোনাল চিকিৎসা।
৪) পিসিওএস থাকলে কী সন্তানধারণ সম্ভব?
সন্তানধারণের পথে পিসিওএস অন্যতম বড় বাধা হলেও সুস্থ জীবনযাত্রা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করে সন্তানধারণ সম্ভব। ওজন কমানো, সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো প্রাথমিক ধাপগুলোর পর চিকিৎসক কিছু ওষুধ দেবেন। তাতেও কাজ না হলে আইভিএফ পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যায়। পরিসংখ্যান বলছে, পিসিওএস সমস্যা রয়েছে এমন মহিলাদের আইভিএফের সাহায্য নিয়ে সন্তানলাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
Related Posts
Written by:
Our Services
Fertility Treatments
Problems with fertility are both emotionally and medically challenging. At Birla Fertility & IVF, we focus on providing you with supportive, personalized care at every step of your journey towards becoming a parent.Male Infertility
Male factor infertility accounts for almost 40%-50% of all infertility cases. Decreased sperm function can be the result of genetic, lifestyle, medical or environmental factors. Fortunately, most causes of male factor infertility can be easily diagnosed and treated.We offer a comprehensive range of sperm retrieval procedures and treatments for couples with male factor infertility or sexual dysfunction.