পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) হল এক ধরনের হরমোন সংক্রান্ত অসুস্থতা যার শিকার হয়ে অসংখ্য প্রজননক্ষম মহিলা এই সমস্যার কারণে কষ্ট পেয়ে থাকেন। এই অসুস্থতার কারণে মাসিক ঋতুচক্র অনিয়মিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীর জুড়েই চুল বা লোমের অত্যধিক বৃদ্ধি, মুখে ব্রণ দেখা দেওয়া এবং ওজন বেড়ে যাওয়ার মতো বিষয় দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের PCOS সম্পর্কিত উপসর্গ কম করার একটি উত্তম উপায় হল সুষম ও স্বাস্থ্যকর ডায়েট। এই ব্লগে, আমরা পলিসিস্টিক ওভারি রোগ বা PCOD-এর উপযুক্ত একটি ডায়েট প্ল্যানের ব্যাপারে আলোচনা করব যা শুধু এইসব উপসর্গকে নির্মূলই করে না, তার সাথে সামগ্রিক সুস্থতার স্তরকেও উন্নীত করতে সহায়তা করে।
PCOD সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলিকে বোঝার চেষ্টা করা
পলিসিস্টিক ওভারি রোগের (PCOD) কারণে মহিলাদের পক্ষে স্বাস্থ্যপ্রদ ওজন বজায় রাখা ও তাদের শরীরে ইনসুলিনের লেভেলকে ম্যানেজ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ইনসুলিন সংক্রান্ত প্রতিরোধকে প্রায়শই PCOD-এর সাথে এক করে দেখা হয়। এর অর্থ হল, এই সমস্যা দেখা দিলে, মহিলাদের শরীর ইনসুলিন কার্যকরীভাবে ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলে রক্তে শর্করা বা ব্লাড সুগারের লেভেল অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে যায় এবং টাইপ 2 ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়ে যায়। এছাড়াও, PCOD-তে আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব সংক্রান্ত সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
একটি সুষম ডায়েট প্ল্যান তৈরি করা
পলিসিস্টিক ওভারি রোগের (PCOD) উপসর্গগুলিকে ম্যানেজ করার স্বার্থে একটি সুষম ডায়েট পালন করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই প্ল্যানে একদিকে ইনসুলিনের লেভেলকে নিয়ন্ত্রণ করার দিকে যেমন নজর দেওয়া হয়, তার সঙ্গে একইসাথে স্বাস্থ্যপ্রদ ওজন বজায় রাখা ও সামগ্রিক সুস্থতাকে উন্নত করার প্রতিও জোর দেওয়া হয়। PCOD-এর জন্য প্রস্তাবিত ডায়েট প্ল্যানে যেসব বিষয় থাকা জরুরি, সেগুলির সম্বন্ধে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল:
- সহজপাচ্য নয় এমন কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার বেছে নিতে হবে: ব্রাউন রাইস, কিনোয়া বা বাথুয়া, হোল হোয়েট ব্রেড ও রিফাইন করা শস্যদানার পরিবর্তে ওটের মতো হোল গ্রেন বেছে নিন। সহজপাচ্য নয় এমন কার্বোহাইড্রেটের মধ্যে গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স অনেক কম পরিমাণে পাওয়া যায় এবং সেগুলির পাচনও অনেক ধীরে ধীরে হয় যার ফলে ব্লাড সুগারের লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়।
- ডায়েট প্ল্যানে সম্পৃক্ত ফ্যাট ও ক্যালরির পরিমাণ কম থাকা ‘লিন’ লেভেলের প্রোটিন যোগ করতে হবে: চিকেনের ব্রেস্টমিট, মাছ, সয়াবিন মিল্ক থেকে তৈরি টোফু, বিভিন্ন ধরনের ডাল ও বিনের মতো ‘লিন’ লেভেলের প্রোটিন আপনার খাদ্যতালিকায় যোগ করুন। প্রোটিন ব্লাড সুগারের লেভেল নিয়ন্ত্রণ করে এবং অল্প একটু খেলেই পেট ভরে যাওয়ার অনুভূতি দেয় যার ফলে একসাথে অনেক বেশি খাবার খেয়ে ফেলার আশঙ্কা থাকে না।
- স্বাস্থ্যপ্রদ ফ্যাটের উপর জোর দিতে হবে: অ্যাভোকাডো, নাট, বিভিন্ন ধরনের বীজ, অলিভ অয়েল ও স্যালমনের মতো ফ্যাট-সমৃদ্ধ মাছের মতো স্বাস্থ্যপ্রদ ফ্যাটের সোর্সগুলিকে নিজের ডায়েটে রাখুন। হরমোন তৈরি ও শরীরের ভিতরে প্রদাহ কম করতে সাহায্য করার ক্ষেত্রে এইসব ফ্যাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- অনেক বেশি পরিমাণে ফাইবার জাতীয় খাবার খেতে হবে: ফল, শাকসব্জী, মটরশুঁটি বা কলাই বা শিম জাতীয় সব্জী ও হোল গ্রেনের মতো ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার খেলে একদিকে ইনসুলিন সংক্রান্ত সংবেদনশীলতা আরও উন্নত হয় এবং অল্প খেলেই পেট ভরে যাওয়ার অনুভূতি দেয় যাতে অত্যধিক খাবার খাওয়ার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
- ডায়েট থেকে চিনি-মেশানো খাবার ও পানীয় দূরে রাখতে হবে: সোডা, ক্যান্ডি, মিষ্টান্ন ও প্যাকেজ-জাত ফ্রুট জুসের মতো চিনি-মেশানো খাবার ও পানীয় যতটা কম খাওয়া যায় ততটাই আপনার পক্ষে ভাল। এগুলি আপনার ব্লাড সুগারের লেভেলকেই শুধু বাড়ায় না তার সাথে আপনার ওজনকেও বাড়াতে থাকে।
- খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে: অত্যধিক ক্যালরি গ্রহণ করার হাত থেকে বাঁচতে খাবারের পরিমাণের দিকে নজর দিন। ছোট প্লেট ও বাটিতে খাবার খান এবং আপনার কখন খিদে পাচ্ছে এবং কখন মনে হচ্ছে যে পেট ভরে গেছে তার উপরে ফোকাস করুন।
- অনেক বেশি জল খেতে হবে: সারা দিন ধরে অনেক বেশি জল খান যাতে শরীরে কখনই জলের অভাব না হয়। এটি সামগ্রিক সুস্থতা বজায় রাখার পাশাপাশি শরীরের ওজনকেও ম্যানেজ করতে সহায়তা করে।
- কফি জাতীয় পানীয় গ্রহণের মাত্রা যেন অত্যধিক না হয়: কফি জাতীয় পানীয়ের মাত্রা কম করলেই তা শরীরের পক্ষে ভাল হয়, কারণ এই জাতীয় পানীয়ের অত্যধিক মাত্রায় সেবন হরমোনের লেভেলকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই কফি, চা ও অন্যান্য ক্যাফেইন-মিশ্রিত পানীয় কম সেবন করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
- প্রদাহ কম করতে সাহায্য করে এমন খাবার ডায়েটে যোগ করতে হবে: অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ও প্রদাহ কম করার গুণসম্পন্ন খাবার PCOD সংক্রান্ত উপসর্গকে কম করতে সাহায্য করে। এগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য খাবারগুলি হল – হলুদ, আঁদা, রসুন, জাম জাতীয় ফল, সবুজ পাতা বিশিষ্ট শাকসব্জী ও গ্রিন টি।
- কোনও পেশাদারি ব্যক্তি বা সংস্থার নির্দেশিকা গ্রহণ করতে হবে: রেজিস্ট্রেশন নম্বর থাকা এমন কোনও ডায়েটিশিয়ান বা পুষ্টিবিদের কাছ থেকেই পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে যারা PCOD-এর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন এবং আপনার নির্দিষ্ট প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে আপনার জন্য কাস্টমাইজ করা একটি ডায়েট প্ল্যান তৈরি করতে সাহায্য করতে পারেন।
উপসংহার
পলিসিস্টিক ওভারি রোগের (PCOD) উপসর্গ ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে সুষম ডায়েট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আপনি তখনই নিজের ইনসুলিনের লেভেলকে আরও ভালভাবে ম্যানেজ করতে, স্বাস্থ্যপ্রদ ওজন বজায় রাখতে ও আপনার সামগ্রিক সুস্থতার স্তরকে তখনই আরও উন্নত করতে পারবেন, যখন আপনি স্বাস্থ্যপ্রদ খাবারের বিকল্প বেছে নেবেন এবং সহজপাচ্য নয় এমন কার্বোহাইড্রেট, ‘লিন’ লেভেলের প্রোটিন, স্বাস্থ্যপ্রদ ফ্যাট, ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার ও খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার উপরে জোর দেওয়া এবং সব দিক বিবেচনা করে তৈরি করা কোনও ডায়েট প্ল্যান অনুসরণ করবেন।
আপনার শারীরিক পরিস্থিতি অনুযায়ী কাস্টমাইজ করা নির্দেশিকা পেতে স্বাস্থ্য পরিষেবার বিশেষজ্ঞ পেশাদারদের সাথেই শলা-পরামর্শ করুন যাতে ডায়েট ও জীবনযাত্রার মানে করা পরিবর্তনের মাধ্যমে PCOD সংক্রান্ত পরিস্থিতিকে ম্যানেজ করতে পারেন। বিড়লা ফার্টিলিটি ও আইভিএফ ক্লিনিকে, বন্ধ্যাত্ব সংক্রান্ত সমস্যায় পীড়িত দম্পতি অথবা এমন কেউ যারা আইভিএফ/আইইউআই-এর মতো প্রজনন কৌশলের সহায়তা চাইছেন, সেইসব মানুষদের জন্য আমাদের অভিজ্ঞ পেশাদার বিশেষজ্ঞের টিম পূর্ণাঙ্গ সহায়তা প্রদান করে। আপনার স্বতন্ত্র পরিস্থিতি সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল চিকিৎসা বিকল্প এক্সপ্লোর করতে, বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলার জন্য আজকেই একটি টাইম বুক করুন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন:
1) ডায়েট কীভাবে PCOD সংক্রান্ত সমস্যার তীব্রতা কম করতে পারে?
পলিসিস্টিক ওভারি রোগের (PCOD) উপসর্গগুলিকে ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে ডায়েট একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। কিছু কিছু খাবার পলিসিস্টিক ওভারি রোগের (PCOD) ইনসুলিন সংক্রান্ত প্রতিরোধ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও প্রদাহের মতো অবস্থাকে আরও গুরুতর করে তুলতে পারে যেগুলি PCOD সংক্রান্ত সমস্যার ক্ষেত্রে খুব সাধারণ। উল্টোদিক দিয়ে দেখতে গেলে, একটি সুষম ডায়েট ইনসুলিনের লেভেল নিয়ন্ত্রণ, ওজন ম্যানেজ করার কাজকে উন্নত করা, প্রদাহ কম করা ও হরমোনের ভারসাম্যতাকে সহায়তা করতে সক্ষম হয়।
2) PCOD সংক্রান্ত সমস্যা থাকলে আমার ডায়েটে কী কী খাবার থাকতে হবে?
পলিসিস্টিক ওভারি রোগের (PCOD) জন্য স্বাস্থ্যপ্রদ ডায়েটে হোল গ্রেন, ‘লিন’ প্রোটিন, ফল, শাকসব্জী ও স্বাস্থ্যপ্রদ ফ্যাটের উপরে জোর দিতে হবে। এমন খাবার তার মধ্যে রাখুন যাতে ফাইবার থাকে, কারণ এই ফাইবার হজমে সহায়তা করার পাশাপাশি ইনসুলিনের লেভেলকেও ম্যানেদ করে। রিফাইন গ্রেনের বদলে ব্রাউন রাইস ও কিনোয়া বা বাথুয়ার মতো সহজপাচ্য নয় এমন কার্বোহাইড্রেট বেছে নিন। চিকেন, মাছ, টোফু বা ডালের মতো ‘লিন’ প্রোটিন এতে থাকতে হবে। আপনার খাবার প্লেটে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যগুণ ডায়েটে বজায় রাখতে বিভিন্ন ধরনের রঙিন ফল ও শাকসব্জীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
3) PCOD সংক্রান্ত সমস্যায় আক্রান্ত হলে আমাকে কি এমন কোনও নির্দিষ্ট কোনও খাবার এড়িয়ে চলতে হবে?
যদিও প্রত্যেকের ডায়েট সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তা কিছুটা আলাদা আলাদা হতে পারে, তবে সাধারণভাবে এটি সাজেস্ট করা হয় যে চিনি-মেশানো স্ন্যাক ও পানীয়, হোয়াইট ব্রেড ও পাস্তার মতো অনেক বেশি প্রসেস করা ফুড গ্রহণ করা এড়িয়ে চলতে হবে অথবা তার গ্রহণ অনেক সীমিত করতে হবে। এছাড়াও, রেড মিটকে আপনার ভোজনের তালিকা থেকে বাদ দিন এবং তার জায়গায় প্রোটিন সংক্রান্ত সোর্সের জন্য ‘লিন’ প্রোটিন বেছে নিন। বিভিন্ন ধরনের ফ্রাই ও বেক করা খাবারে ট্রান্স ফ্যাট থাকে বলে সেইসব খাবার খাওয়া যতটা কম করা যায়, ততই ভাল কারণ তা শরীরের ভিতরে প্রদাহের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
4) এমন কোনও নির্দিষ্ট সাপ্লিমেন্ট বা ভেষজ আছে যা PCOD সংক্রান্ত উপসর্গকে কম করতে সাহায্য করতে পারে?
নির্দিষ্ট কয়েকটি সাপ্লিমেন্ট ও ভেষজ বেশ কিছু ক্ষেত্রে PCOD সংক্রান্ত উপসর্গ কম করতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্রদাহ করার পক্ষে সহায়ক ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড মাছের তেলে পাওয়া যায়। ‘ইনোসিটোল’ সাপ্লিমেন্ট শরীরের ইনসুলিন সংক্রান্ত সংবেদনশীলতাকে উন্নত করতে পারে। যদিও কোনও নতুন সাপ্লিমেন্ট বা ভেষজ ওষুধের ব্যবহার শুরু করার আগে, সেগুলি আপনার জন্য নিরাপদ কিনা এবং আপনার চলমান চিকিৎসাতে তারা কোনও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না, তার ব্যাপারে সুনিশ্চিত করতে, কোনও স্বাস্থ্য পরিষেবা পেশাদারের সাথে আলোচনা করে নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি।
5) PCOD-এর জন্য কি আমাকে রেজিস্ট্রেশন নম্বর থাকা কোনও ডায়েটিশিয়ানের সাথেই আলোচনা করা উচিত?
অবশ্যই! PCOD সংক্রান্ত সমস্যার ব্যাপারে বিশেষ জ্ঞান রয়েছে এমন কোনও রেজিস্ট্রেশন নম্বর থাকা ডায়েটিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করলে তার ফল অনেক ভাল হতে পারে। তাঁরা আপনার নির্দিষ্ট প্রয়োজন, পছন্দ ও লক্ষ্য অনুযায়ী কাস্টমাইজ করা ব্যক্তিগত ডায়েট প্ল্যান তৈরি করে দিতে সক্ষম হন। তাছাড়া, একজন ডায়েটিশিয়ান আপনাকে একটানা সহায়তা প্রদান করতে, কোন খাবারের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে তা শনাক্ত করতে সহায়তা করতে এবং আপনাকে খাবারের পরিমাণ ও মিলের ব্যাপারে প্ল্যান করার বিভিন্ন কৌশলের বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলতে পারেন যাতে ডায়েটের মাধ্যমে PCOD সংক্রান্ত সমস্যা কার্যকর পদ্ধতিতে ম্যানেজ করা যায়।
Leave a Reply