অ্যামেনোরিয়া ও তার চিকিৎসা
নারী শরীরের প্রজননতন্ত্র অত্যন্ত জটিল। গর্ভধারণের জন্য প্রতি মাসে একবার করে তৈরি হয় সে। আবার গর্ভে ভ্রূণের সৃষ্টি না হলে নিয়ম করে ভেঙেচুরে দেয় সাজানো বাসা। এটাই ঋতুস্রাব। কোনও কারণে এই ঋতুস্রাব শুরু না হওয়া বা শুরু হয়েও থমকে যাওয়াকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলে অ্যামেনোরিয়া। নানা কারণে এটা হতে পারে এবং সেগুলি অধিকাংশই চিকিৎসায় সারানো সম্ভব। গড়িমসি করে সমস্যা জিইয়ে রাখলে বরং জটিলতা বাড়তে পারে। তাই ঋতুচক্রে কোনও অনিয়ম হলে দ্রুত চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।
অ্যামেনোরিয়া কী
এক কথায়, অ্যামেনোরিয়া মানে ঋতুবন্ধ বা মাসিক ঋতুস্রাব না হওয়া। রজঃস্বলা হওয়ার পরে প্রতি ঋতুচক্রে ডিম্বাশয় থেকে একটি ডিম নিঃসৃত হয় ও সম্ভাব্য গর্ভধারণের জন্য তৈরি হয় জরায়ু। ডিমটি নিষিক্ত না হলে জরায়ু থেকে এন্ডোমেট্রিয়াল লাইনিংগুলি ঝরে যায় ঋতুস্রাবের মাধ্যমে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন রকমের হরমোন। সাধারণত মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাস থেকে নিঃসৃত গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন পিটুইটারি গ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (এফএসএইচ) ও লুটেনাইজিং হরমোন (এলএইচ) নিঃসরণের জন্য। এই দু’টি হরমোন আবার ডিম্বাশয় থেকে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন নিঃসরণে উদ্দীপিত করে, যা ঋতুস্রাবকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রোল্যাকটিন এলএইচ ও এফএসএইচ হরমোনের মাত্রাকে প্রভাবিত করে পরোক্ষে ঋতুস্রাবকে নিয়ন্ত্রণ করে। একই ভাবে থাইরয়েড হরমোন টিএসএইচ ও প্রোল্যাকটিনের ক্ষরণকে প্রভাবিত করে পরোক্ষে ঋতুস্রাবকে নিয়ন্ত্রণ করে। এতগুলি হরমোনের কাটাকুটি খেলার কোথাও গোলমাল হলেই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। যার পরিণতি ঋতুবন্ধ বা অনিয়মিত ঋতুস্রাব।
অ্যামেনোরিয়ার প্রকারভেদ
অ্যামেনোরিয়া দু’ধরনের- প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি।
১) ১৬ বছরেও কেউ ঋতুমতী না হলে বা ঋতুস্রাব শুরু না হলে তাকে বলে প্রাইমারি অ্যামেনোরিয়া। এটা সাধারণত জন্মগত ত্রুটি। ক্রোমোজোমাল ও জিনগত দুর্ঘটনার জেরে প্রজনন অঙ্গ ঠিক মতো গড়ে না উঠলে এমনটা হয়। তবে অনেকসময় পরবর্তীকালেও শরীরের কোনও জটিলতা থেকে প্রজননতন্ত্রের ত্রুটি হতে পারে।
২) ঋতুমতী মহিলার টানা তিন মাস বা তার বেশি সময় ঋতুস্রাব বন্ধ থাকলে তাকে বলে সেকেন্ডারি অ্যামেনোরিয়া। এটাও নানা কারণে হতে পারে। মেনোপজ বা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে হতে পারে আবার স্ট্রেস বা কোনও রকম মানসিক সমস্যা থেকেও হতে পারে।
অ্যামেনোরিয়ার কারণ
নানা কারণে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা শুরু না হতে পারে। এর মধ্যে কিছু স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিয় পরিবর্তনের কারণে হয়, কিছু আবার জটিল কোনও অসুস্থতার উপসর্গ হিসাবে জানান দেয় শরীরকে।
প্রাইমারি অ্যামেনোরিয়ার কারণ-
১) অনেকসময় ভ্রূণের বিকাশের সময় দুর্ঘটনাবশত প্রজননতন্ত্রের বিকাশ অসম্পূর্ণ থাকে বা ঠিকমতো প্রজননঅঙ্গ গঠিত হয় না। যেমন, এমআরকেএইচ সিনড্রোমে আক্রান্তদের জরায়ু ও যোনি (আংশিক) অনুপস্থিত থাকে। ফলে মাসিক ঋতুস্রাব হয় না এবং স্বাভাবিক ভাবে গর্ভধারণ সম্ভব নয়।
২) আশারম্যান সিনড্রোম হল এমন একটা অবস্থা (জন্মগত নয়) যেখানে জরায়ুতে ক্ষত কোষ জন্মাতে থাকে। অস্ত্রোপচার বা কোনও কারণে জরায়ুতে আঘাত লাগলে এমনটা হয়। এই ক্ষত কোষ স্বাভাবিক এন্ডোমেট্রিয়াল লাইনিং তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে ঋতুস্রাব অনিয়মিত হয়ে পড়ে বা বন্ধ থাকে।
৩) ক্রোমোজোমাল বা জিনগত ত্রুটির ফলে অনেক সময় প্রজননতন্ত্র ঠিক ভাবে গঠিত হয় না। যেমন, টার্নার সিনড্রোমে (৪৫ এক্স বা ৪৫ এক্সজিরো) মাসিক ঋতুস্রাব হয় না বা শুরু হতে দেরি হয়। এটি জন্মগত ত্রুটি।
সেকেন্ডারি অ্যামেনোরিয়ার কারণ-
১) গর্ভে প্রাণের সঞ্চার হলে প্রকৃতির নিয়মে আপনা থেকে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়।
২) সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় (ল্যাকটেশন) ঋতুস্রাব অনিয়মিত হয়ে যায়। এটা মূলত প্রোল্যাকটিনের মাত্রা বৃদ্ধি এবং লুটেনাইজিং হরমোন-এর মাত্রা কমে যাওয়ার জন্য হয়, যা ডিম্বাশয় থেকে নারী হরমোনের ক্ষরণ কমায়।
৩) মেনোপজের আগে ও মেনোপজ চলাকালীন ঋতুস্রাব অনিয়মিত হয় এবং মাঝেমধ্যেই বন্ধ থাকে। মেনোপজ পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পর একেবারের জন্য ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়।
৪) জন্ম নিরোধক বড়ি খেলে অনেকের ঋতুস্রাব বন্ধ থাকে। এমনকী ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পরও ঋতুস্রাব ঠিক ভাবে শুরু হতে কিছু মাস লেগে যায়। জন্মনিরোধক অন্যান্য পদ্ধতিগুলিও অ্যামেনোরিয়ার কারণ হতে পারে।
৫) কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে ঋতুস্রাব বন্ধ থাকে। যেমন, ক্যানসার রোধে কেমোথেরাপি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রক ওষুধ, মানসিক অবসাদের ওষুধ বা অ্যান্টিডিপ্রেশ্যান্টস, অ্যালার্জির ওষুধ।
৬) শরীরের ওজন অনেকটাই কম হলে ঋতুস্রাব অনিয়মিত হতে পারে। বিশেষ করে ইটিং ডিজ়অর্ডার থাকলে (অ্যানোরেক্সিয়া, বুলিমিয়া) হরমোনের তারতম্যের কারণে এমনটা হতে পারে।
৭) খুব বেশি শরীরচর্চা করলেও ঋতুস্রাবে বাধা পড়ে।
৮) দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেস মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাসের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করায় শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। যা থেকে ওভ্যুলেশন বা ডিম ফোটা এবং ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৯) থাইরয়েডের অস্বাভাবিক ক্ষরণ, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা পিসিওএস, পিটুইটারি টিউমার ইত্যাদি শারীরিক অসুস্থতার জেরে শরীরে হরমোনের ভারসাম্যের পরিবর্তন হলে তা থেকে ঋতুস্রাব বন্ধ থাকতে পারে।
১০) জরায়ুতে টিউমার হলে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
১১) অতিরিক্ত মেদ বা ওবেসিটি থেকে যে শারীরিক সমস্যাগুলি হয় তা ঋতুস্রাবে বাধা দিতে পারে।
১২) ক্রনিক রোগ যেমন কিডনির সমস্যা, ইনফ্লেমেটেরি বাওল ডিজ়িজ় ইত্যাদির কারণে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
১৩) অনেকসময় টিস্যু দিয়ে তৈরি পাতলা দেওয়াল যোনিদেশকে দু’ভাগে বিভক্ত করে (ভ্যাজাইনাল সেপটাম), যা ঋতুস্রাবের সময় রক্তপাতে বাধা দেয়। এটি একটি জন্মগত ত্রুটি।
অ্যামেনোরিয়ার লক্ষ্মণ
কারণের ভিত্তিতে লক্ষ্মণ নানা রকম হতে পারে-
১) স্তনবৃন্ত থেকে দুধের মতো সাদা রস ক্ষরণ।
২) মাথা ব্যথা।
৩) চুল পড়া।
৪) দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন।
৫) অস্বাভাবিক হারে মুখে ও শরীরে লোম।
৬) মুখে ব্রণ।
৭) যোনিদেশে শুষ্কভাব।
৮) শ্রোণিদেশে ব্যথা।
৯) হট ফ্লাশ।
১০) গয়টার (বর্ধিত থাইরয়েড গ্ল্যান্ড)।
অ্যামেনোরিয়া নির্ণয়
ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে গড়িমসি না করে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া উচিত। চিকিৎসক প্রথমেই মেডিক্যাল হিস্ট্রি জানতে চাইবেন এবং সেই সঙ্গে পেলভিক এক্সাম করে দেখে নেবেন বাহ্যিক গঠনগত কোনও ত্রুটি বা সমস্যা রয়েছে কি না। এরপর পরিস্থিতি বুঝে প্রেগন্যান্স টেস্ট করতে দিতে পারেন চিকিৎসক। কিংবা হরমোনের ভারসাম্য জানার জন্য কিছু রক্ত পরীক্ষা করতে বলতে পারেন। ৪০-এর আগে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে জেনেটিক পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে সেটা প্রাইমারি ওভারিয়ান ইনসাফিশিয়েন্সি কিনা। ঋতুবন্ধের সাথে সাথে আরও অন্যান্য কিছু উপসর্গে পিটুইটারি গ্ল্যান্ডে সমস্যা রয়েছে মনে হলে এমআরআই করতে বলতে পারেন চিকিৎসক। ডিম্বাশয় বা জরায়ুতে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না জানার জন্য আলট্রাসাউন্ড করা হয়।
অ্যামেনোরিয়ার চিকিৎসা
১) ল্যাকটেশন বা মেনোপজ বা গর্ভধারণের কারণে ঋতুবন্ধ হয়ে গেলে তা সারানোর দরকার নেই। সেক্ষেত্রে অন্য চিকিৎসা চলে। ২) ক্ষেত্রবিশেষে অ্যামেনোরিয়া সারানোর জন্য সার্জারির (ডিম্বাশয়ে সিস্ট, পিটুইটারি টিউমার, জরায়ুর ক্ষতকোষ অপসারণ ইত্যাদি) সাহায্য নিতে হয়। ভ্যাজাইনাল সেপটাম, ইমপারফোরেট হাইমেনের মতো যোনির গঠনগত ত্রুটি সার্জারি করে ঠিক করা যায়।
৩) স্ট্রেস কমাতে বা অন্যান্য মানসিক সমস্যা দূর করতে কাউন্সেলিং উপায়। ইটিং ডিজ়অর্জার ঠিক করতে কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন।
৪) ওজন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নির্দিষ্ট ডায়েট চার্ট মেনে চলতে হবে।
৫) অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমাতে ক্যালশিয়াম ও ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ওষুধও খেতে হয়।
৬) হরমোনের তারতম্য থেকে ঋতুবন্ধের সমস্যা হলে হরমোনাল থেরাপি শুরু করা হয়।
সবশেষে বলা যায়, হরমোনের চিকিৎসাই মূল চিকিৎসা। সমস্যা যেখানেই হোক না কেন ঘুরেফিরে সেই হরমোনে এসে আটকায়। শরীরে হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নানারকমের ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। এছাড়া সুস্থ জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্যকর খাবার, শরীরচর্চার অভ্যাস হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা
১) অ্যামেনোরিয়া থেকে কী কী শারীরিক জটিলতা হতে পারে?
ঋতুস্রাব ঠিক মতো না হলে বা অনিয়মিত হলে বা একেবারেই না হলে সবার আগে যে সমস্যাটি হতে পারে তা হল সন্তানধারণে অক্ষমতা। শ্রোণীদেশে ব্যথা হয়। অনিয়মিত ঋতুস্রাব ও ঋতুবন্ধ থেকে দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেস তৈরি হয়, যেখানে থেকে আরও অনেক মানসিক সমস্যা বাসা বাধে। এছাড়া ইস্ট্রোজেনের অভাবে অস্টিওপোরোসিস ও কার্ডিওভাসকুলার রোগ হতে পারে।
২) অ্যাথলেটিক অ্যামেনোরিয়া কাকে বলে?
প্রলম্বিত বা অতিরিক্ত শরীরচর্চার ফলে শরীরে ইস্ট্রোজেনের তারতম্য হলে ঋতুস্রাবের উপরে তার প্রভাব পড়ে এবং ঋতুবন্ধ পর্যন্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে শরীরচর্চা কমিয়ে ক্যালোরি ইনটেক বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
৩) অ্যামোনেরিয়ার ঝুঁকি কমাতে কী খাবার খেতে হবে?
প্রসেসড খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। ক্যাফিন ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা ভাল। হোল গ্রেন খাবার, শাকসব্জি, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার, বাদাম, বীজ, মাছ যেন ডায়েটে থাকে। ডায়েটে ফ্যাট খুব কম হয়ে গেলে অ্যামেনোরিয়ার ঝুঁকি থাকে। ভিটামিন বি-সিক্স প্রোল্যাকটিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। ব্ল্যাক কোহোশ, লেডিস ম্যান্টলের মতো কিছু হার্ব রয়েছে, যেগুলি শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। যদিও এগুলি বাস্তবে কতটা কার্যকরী তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।