নারীদের যৌনাঙ্গে বিভিন্ন কারণে সংক্রমণ হতে পারে। ইস্ট বা ফাঙ্গাস থেকে সংক্রমণ এর মধ্যে অন্যতম। চিকিৎসা পরিভাষায় যার নাম ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন। প্রতি চার জন নারীর মধ্যে অন্তত এক জন জীবনে কখনও না কখনও এই পরিস্থিতির মুখে পড়েন। তবে, সজাগ-সচেতন থাকলে যেমন এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়, তেমন চিকিৎসার মাধ্যমে এর নিরাময়ও সম্ভব।
ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন কী
ক্যানডিডা নামে এক ধরনের ইস্ট বা ফাঙ্গাস আমরা শরীরে বয়ে বেড়াই অজান্তে। ত্বকে বা গলায়, মুখের ভিতরে, পরিপাক নালীতে এই ফাঙ্গাস থাকে। ‘গুড ব্যাকটেরিয়া’রা এদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে এমনিতে এরা উপস্থিত থাকলেও শরীরে কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু কোনও কারণে এই ফাঙ্গাস যৌনাঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত বিস্তার করে সংক্রমণের আকার নেয়। একে বলে ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন। এই রোগ হলে যোনিতে জ্বালা ধরা ভাব, চুলকানির পাশাপাশি যোনিদ্বারের রং লালচে হয়ে যায়। এর সাথে যোনি থেকে অস্বাভাবিক ক্ষরণ হয়। সহবাসে ও মূত্রত্যাগের সময় জ্বালা ভাব বাড়ে। তবে এই রোগ হলে দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধে ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন সেরে যায় এক সপ্তাহের মধ্যে।
ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন কেন হয়
যৌনাঙ্গে ক্যানডিডার বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সংক্রমণের আকার নেয়। নানা কারণে এটা হতে পারে-
১) অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব- অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে যৌনাঙ্গে উপস্থিত ‘গুড ব্যাকটেরিয়া’ মারা গেলে ‘ব্যাড’ ফাঙ্গাস ছড়িয়ে পড়ে।
২) হরমোনের তারতম্য- শরীরে হরমোনের তারতম্য হলে যোনিদেশে যে ভারসাম্য অবস্থা ছিল তা বিঘ্নিত হয় এবং সেই সুযোগে ক্যানডিডা বিস্তার করে। গর্ভাবস্থায় হরমোনের তারতম্য হয় শরীরে। আবার জন্ম নিরোধক বড়ি খেলে এমনকী ঋতুচক্রের বিভিন্ন সময়ে যে হরমোনের তারতম্য হয় তা থেকেও এই ইনফেকশন হতে পারে।
৩) ডায়াবেটিস- রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গেলে মূত্রে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়ার উপরে তার প্রভাব পড়ে যা থেকে আবার ফাঙ্গাল সংক্রমণ হতে পারে।
৪) দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা- শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা অনাক্রম্যতার ক্ষমতা দুর্বল হলে সেখান থেকে এই ফাঙ্গাল সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। এইচআইভি-র ওষুধ খেলে বা কেমোথেরাপি, রেডিয়েশনের জন্য শরীরে অনাক্রম্যতার পার্থক্য হয়।
৫) স্বাস্থ্যবিধি- অপরিচ্ছন্ন, ভেজা অন্তর্বাস পরে থাকলে তা থেকে ফাঙ্গাসের আক্রমণ হতে পারে। ঘর্মাক্ত অন্তর্বাসও পরে থাকা উচিত নয়। কারণ ঘাম ও আর্দ্রতা থেকে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হয়। জেট স্প্রে ওয়াশ ব্যবহারের সময় যৌনাঙ্গের ভিতর জোরে জল দিলে কিছু ভাল ব্যাকটেরিয়া ধুয়ে যায়, যা ইস্ট ইনফেকশন থেকে রক্ষা করতে পারত। যৌনাঙ্গে সুগন্ধী কোনও জিনিস যেমন, সুগন্ধী ট্যাম্পোন বা প্যাড বা ডিওড্র্যান্ট ব্যবহার করলে তা থেকেও এই ধরনের ইস্ট সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
কাদের ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন হয়
যে কোনও মহিলার ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন হতে পারে। তবে বয়ঃসন্ধিকাল থেকে মেনোপজের সময় পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এমনিতে এটি মেয়েদের রোগ হলেও, ছেলেরাও ইস্ট ইনফেকশনে আক্রান্ত হতে পারে। শিশ্নে ইস্ট ইনফেকশন হলে তাকে বলে পেনাইল ইস্ট ইনফেকশন। জ্বালাভাব ও চুলকানি এর উপসর্গ। যৌনসংসর্গ থেকে এই রোগ সংক্রামিত হয়। প্রসঙ্গত, ছোট বাচ্চাদেরও ডায়াপার থেকে ইস্ট ইনফেকশন হতে পারে। এটি ক্ষতিকর না হলেও সময়ে চিকিৎসা করা দরকার।
ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের লক্ষ্মণ
১) প্রথম ও প্রধান লক্ষ্মণ হল যোনি ও যোনিদ্বারে চুলকানি ও জ্বালাভাব।
২) মূত্রত্যাগ ও সহবাসের সময় জ্বালাভাব বাড়ে।
৩) যোনিদ্বার লালচে হয়ে যায়। ছোট কাটাদাগ বা চিড়ের মতো হতে পারে।
৪) ইস্ট ইনফেকশন হলে সাদা রঙের, তুলনায় ঘন যোনিস্রাব হতে থাকে। তবে, এটি দুর্গন্ধহীন হবে। দুর্গন্ধ থাকলে সেটি অন্য রোগের উপসর্গ।
ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন নির্ণয়
ইস্ট ইনফেকশনের লক্ষ্মণের সঙ্গে যোনিতে আরও বেশ কয়েক প্রকার সংক্রমণের লক্ষ্মণ মিলে যায়। যেমন, ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস বা যৌনবাহিত রোগের (এসটিডি) প্রাথমিক লক্ষ্মণগুলি অনেকটা এক। তাই চিকিৎসক প্রথমে মেডিক্যাল হিস্ট্রি অর্থাৎ আগে কখনও যোনিতে সংক্রমণ হয়েছে কি না সে সম্পর্কে খোঁজ নেবেন। ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের কিছু লক্ষ্মণ অন্যদের থেকে আলাদা। যেমন, ইস্ট ইনফেকশনের ক্ষেত্রে স্রাব দুর্গন্ধযুক্ত হয় না। ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিসে যে স্রাব হয় সেটি দুর্গন্ধপূর্ণ। ইস্ট ইনফেকশনের ক্ষেত্রে যোনিদ্বার লালচে রঙের হয়ে যায়। ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিসে এটা দেখা যায় না। এই লক্ষ্মণগুলো নির্ণয় করার জন্য ‘পেলভিক এক্সাম’ করেন চিকিৎসক। আরও নিশ্চিত হতে স্রাবের নমুণা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয় ফাঙ্গাল কালচারের জন্য।
ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের চিকিৎসা
অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুদের সাহায্যে অধিকাংশ ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের চিকিৎসা হয়ে যায়। সংক্রমণ কতটা তার উপরে নির্ভর করে কী ওষুধ দেওয়া হবে। খাওয়ার ওষুধ রয়েছে (ফ্লুকোনাজোল)। আবার যোনিতে সরাসরি লাগানোর মতো ওষুধও রয়েছে। প্রচলিত অন্য অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধগুলি হল মাইকোনাজোল, টার্কোনাজোল, ক্লোট্রিমাজোল, বুটোকোনাজোল। সাধারণত ওষুধ পড়লে এক সপ্তাহের মধ্যে এই সংক্রমণ সেরে যায়।
প্রসঙ্গত, চিকিৎসক ওষুধ যত দিন নিতে বলবেন, ততদিনই নিতে হবে। কারণ পুরোপুরি না সারলে অনেকসময় আবার এই সংক্রমণ ফিরে আসে চটজলদি। অনেকসময় প্রেসক্রিপশন ছাড়া দোকান থেকে অ্যান্টিফাঙ্গাল মলম কিনে ব্যবহার করে কেউ কেউ। কিন্তু ইস্ট ইনফেকশন হয়েছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরেই ওষুধ লাগানো উচিত। আর একটা কথা মাথায় রাখা দরকার, যৌনাঙ্গে সংক্রমণ হলে তা সেরে না যাওয়া পর্যন্ত যৌনসংসর্গ না করাই ভাল। কারণ সেক্ষেত্রে সঙ্গী সংক্রামিত হতে পারে।
বাড়িতে ইস্ট ইনফেকশন সারানোর উপায়
ইস্ট ইনফেকশন সারানোর জন্য ঘরোয়া কিছু উপায় রয়েছে। তবে এগুলি কতটা কার্যকরী তা নিয়ে মতভেদ আছে।
১) দই- প্রোবায়োটিক ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে সবসময় কার্যকরী। কারণ এটিতে ‘লাইভ ব্যাকটেরিয়া’ (যেমন, ল্যাকটোব্যাসিলাস অ্যাসিডোফিলাস) থাকে। গবেষণা বলছে দই বা ইয়োগার্ট মাইক্রোবায়োমের বিস্তারে সাহায্য করে যা ইস্টের সংক্রমণ আটকায়। চিনি ছাড়া দই (গ্রিক ইয়োগার্ট) খেলে তাই উপকার পাওয়া যায়। যোনিদ্বার ও যোনিতে সরাসরি দইও লাগানো যেতে পারে।
২) বোরিক অ্যাসিড- বোরিক অ্যাসিড খুব শক্তিশালী অ্যান্টিসেপটিক। বোরিক অ্যাসিড ভ্যাজাইনাল সাপোজ়িটোরিস ইস্ট ইনফেকশন আটকাতে পারে। তবে বেশি পরিমাণে বোরিক অ্যাসিডের প্রয়োগ শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। কোনও ক্ষত বা কাটা থাকলে সেখানে বোরিক অ্যাসিড লাগানো উচিত না এবং এটি খাওয়া যায় না। গর্ভাবস্থাতে কোনও ভাবে বোরিক অ্যাসিড ব্যবহার করা যাবে না।
৩) এসেনশিয়াল অয়েল- অলিভ বা আমন্ড অয়েলের সাথে তিন থেকে পাঁচ ফোঁটা অরিগ্যানো এসেনশিয়াল অয়েল (ওয়াইল্ড অরিগ্যানো থেকে সংগৃহীত) কিংবা টি-ট্রি অয়েল মিশিয়ে তা ত্বকে মেখে উপকার পাওয়া যায়। তবে, এটি যোনিদেশে লাগানো যাবে না।
৪) নারকেল তেলে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপকরণ আছে। যৌনাঙ্গে লাগিয়ে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
৫) রসুন, ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খেলে ইস্ট ইনফেকশন তাড়াতাড়ি সেরে যায়।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা
১) ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন কি নিজে থেকে সেরে যেতে পারে?
সংক্রমণ খুব কম হলে অনেকসময় নিজে থেকে সেরে যায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা করাতে হয়। তাছাড়া সংক্রমণ কম হলেও চিকিৎসা করিয়ে নেওয়া ভাল। নয়তো এটি ফিরে ফিরে আসে। অনেকসময় আবার রেখে দিলে সংক্রমণ পরবর্তীকালে বেড়ে গিয়ে পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে ওঠে।
২) ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন এড়াতে কী করতে হবে?
কিছু বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকলে এই রোগ এড়ানো যায়। যেমন, যৌনাঙ্গের ভিতরে জোরে জলের ঝাপটা দেওয়া উচিত নয়। এতে গুড ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয়ে যায়, যা ফাঙ্গাসের বিস্তার আটকাতে পারত। যোনিদেশে সুগন্ধী জিনিসপত্র, সে প্যাড হোক বা ট্যাম্পোন, না ব্যবহার করাই ভাল। স্নান করে এসে ভেজা অন্তর্বাস না ছাড়া বা জিম করার পরে ঘামে ভেজা অন্তর্বাস পরে থাকার মতো অভ্যাস থাকলে বদলাতে হবে। পরিচ্ছন্ন, হালকা, সূতির অন্তর্বাস পরা উচিত। ডায়াবেটিস থাকলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যখন-তখন অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া উচিত নয়। দই বা প্রোব্যাকটেরিয়া সাপ্লিমেন্ট খেলে ল্যাকটোব্যাসিলাস বা ‘গুড ব্যাকটেরিয়া’ বাড়ে। ফলে ইস্ট ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি কমে।
৩) ঋতুস্রাবের সময় কি ইস্ট ইনফেকশনের সম্ভাবনা বাড়ে?
হ্যাঁ, মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার আগে ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে। হরমোনের তারতম্যের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। ঋতুস্রাবের সময় এই ধরনের ইনফেকশনের সমস্যা হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যায়। ঋতুস্রাব শেষ হওয়ার পরও ইনফেকশন না কমলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। আর একাধিক বার এমনটা ঘটে থাকলে অতি অবশ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৪) গর্ভাবস্থায় ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন হলে কী করণীয়?
হরমোনের তারতম্য হয় বলে গর্ভাবস্থায় ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কোনও কারণে এটা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। খাওয়ার ওষুধ এক্ষেত্রে দেওয়া হয় না। অ্যান্টি ফাঙ্গাল মলম বা জেল ব্যবহার করা যায় শুধু। এমনিতে ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের জন্য গর্ভস্থ সন্তানের কোনও ক্ষতি হয় না। তবে প্রসবের সময় যোনিতে এই ইনফেকশন থাকলে তা সন্তানের কাছে চলে যেতে পারে। তাই জন্য ইনফেকশন হলে প্রসবের আগেই তা সারিয়ে ফেলা উচিত।