
শুক্রাণু বিশ্লেষণ পরীক্ষা কি

Table of Contents
প্রজননে অক্ষমতার সমস্যায় প্রথমেই আঙুল ওঠে নারীর দিকে। কিন্তু সন্তানধারণে অক্ষম কোনও দম্পতি চিকিৎসকের দ্বারস্থ হলে প্রথমে যে পরীক্ষাটি করতে দেওয়া হয়, সেটি হল বীর্যের পরীক্ষা বা সিমেন অ্যানালাইসিস। কারণ, চিকিৎসার দাঁড়িপাল্লায় পুরুষ ও নারীর আলাদা করে মান-সম্মান বা গুরুত্ব নেই। একটি ভ্রূণের সৃষ্টির জন্য উৎকৃষ্ট ডিম্বাণু যেমন দরকার, তেমনই প্রয়োজন সুস্থ-সবল-সচল শুক্রাণুর। চিকিৎসার শুরুতে দম্পতির সাধারণ রক্ত পরীক্ষা বা হরমোন পরীক্ষার সঙ্গে পুরুষের বীর্য-বিশ্লেষণ (সিমেন অ্যানালাইসিস/ স্পার্ম কাউন্ট টেস্ট) করিয়ে নেওয়ার কারণ হল, এই পরীক্ষা তুলনায় সহজ, খরচ কম, ধকল নেই, ঝুঁকি নেই।
বীর্য পরীক্ষা বা সিমেন অ্যানালাইসিস টেস্ট
পুরুষের বীর্যরস (সিমেন) সংগ্রহ করে তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয় সিমেন অ্যানালাইসিস টেস্টে (সেমিনোগ্রাম বা স্পার্মিওগ্রাম)। মূলত বীর্যরসের শারীরবৃত্তিয় বৈশিষ্ট্য (রঙ, গন্ধ, পিএইচ, সান্দ্রতা বা ভিসকোসিটি এবং তরলতা), শুক্রাণুর সংখ্যা (কনসেনট্রেশন), আকার (মরফোলজি) ও গতিশীলতার (মোটিলিটি) বিশ্লেষণ করা হয় এই পরীক্ষায়। একসঙ্গে এই সব ক’টি মাপকাঠিতে পাশ করা কঠিন। একজন প্রজননক্ষম পুরুষের ক্ষেত্রেও মাত্র ৪ শতাংশ স্পার্মাটোজোয়া সমস্ত মাপকাঠিতে পাশ করতে পারে। বাকি ৯৬ শতাংশের কোনও না কোনও দিকে খামতি থাকে।
কখন বীর্য পরীক্ষা করা উচিত
কোনও দম্পতি যদি এক বছর চেষ্টা করার পরও সন্তানধারণ না করতে পারে, সেক্ষেত্রে তাদের সন্তানধারণে অক্ষমতার সমস্যা আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসেকরা প্রথমেই স্পার্ম অ্যানালাইসিস টেস্ট করিয়ে দেখে নেন শুক্রাণুর কোনও সমস্যা রয়েছে কি না। এছাড়া ভ্যাসেক্টোমি করার পরে বীর্যরসে শুক্রাণু আসছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে এই পরীক্ষা করা হয়।
বীর্য পরীক্ষার প্রস্তুতি
পরীক্ষার ফলাফল সঠিক পেতে হলে প্রস্তুতি-পর্বে কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে এবং এই নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে সেই মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।
১) পরীক্ষার ৪-৫ দিন আগে থেকে হস্তমৈথুন বা যৌনসংসর্গে বিরতি দিলে বেশি পরিমাণ ও উন্নত মানের বীর্যরস পাওয়া যায়। তবে, এই বিরতি যেন দু’সপ্তাহ বা তার বেশি না হয়।
২) মদ্যপান, ধূমপান, নেশার বস্তু বা ক্যাফিন রয়েছে এমন সামগ্রী ২-৫ দিন এড়িয়ে চলতে হবে।
৩) হরমোনের কোনও ওষুধ খেলে সেটা বন্ধ রাখতে বলতে পারেন চিকিৎসক।
বীর্য সংগ্রহের পদ্ধতি
বীর্য সংগ্রহের সাধারণ উপায় হল হস্তমৈথুন। ক্লিনিক বা যেখানে পরীক্ষাটি হবে, সেখানেই নমুনা সংগ্রহ করা উচিত, তাহলে অকারণ সময় নষ্ট হবে না বা স্থান পরিবর্তনের জন্য তাপমাত্রার পরিবর্তন হবে না। কারণ যথার্থ ফল পেতে এই দু’টি ফ্যাক্টর সবচেয়ে বেশি জরুরি। তাপমাত্রার পরিবর্তনে শুক্রাণুর ক্ষতি হয়। খুব গরম বা খুব ঠান্ডায় ফলাফল ভুল আসবে। আর মোটামুটি ভাবে আধ থেকে এক ঘ্ণ্টার মধ্যে বীর্য নমুনা পরীক্ষাগারে পৌঁছতে হবে। হস্তমৈথুন ছাড়াও কন্ডোমের সাহায্যে বা এপিডিডাইমাল নিষ্কাশনের মাধ্যমে বীর্যরস সংগ্রহ করা যেতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষ যেমন রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন, নার্ভে আঘাত বা মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রো-স্টিমুলেশন, ভাইব্রো-স্টিমুলেশনের মতো বিকল্প কিছু পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়।
বীর্য বিশ্লেষণের পরামিতি
- শুক্রাণুর সংখ্যা- পুরুষের সন্তানধারণে অক্ষমতার একটা বড় কারণ বীর্যরসে শুক্রাণুর সংখ্যা পরিমিত না থাকা (লো স্পার্ম কাউন্ট)। হু-র নির্দেশিকায় (২০২১) প্রতি মিলিলিটার বীর্যে কমপক্ষে ১৬ মিলিয়ন শুক্রাণু থাকার কথা বলা হলেও চিরাচরিত ধারণায়, সন্তানলাভের জন্য প্রতি মিলিলিটার বীর্যে ২০ মিলিয়ন শুক্রাণু দরকার। সাধারণ ভাবে প্রতি মিলিলিটার বীর্যরসে শুক্রাণুর সংখ্যা ৪০-২০০ মিলিয়নের মধ্যে থাকে।
- শুক্রাণুর গতিশীলতা- শুক্রাণুর সংখ্যার পরেই যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল গতিশীলতা (মোটিলিটি) বা শুক্রাণুর সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। কারণ নিষিক্তকরণের জন্য অবশ্যই ডিম্বাণুর কাছে গিয়ে পৌঁছতে হবে শুক্রাণুকে। শুক্রাণুর গতিশীলতা ০ থেকে চারে রেটিং করা হয়। ০ হলে শুক্রাণুর চলন নেই আর ৩-৪ হলে ভাল গতিশীলতা রয়েছে বলা হয়। মোটামুটি ভাবে ৫০ শতাংশের বেশি শুক্রাণুর গতিশীলতা স্বাভাবিক থাকলে সন্তানধারণে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। হু-র নির্দেশিকায় ৪২ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। এক জন পুরুষের প্রতি মিলিলিটারে ১৬ মিলিয়নের বেশি শুক্রাণু থাকা সত্ত্বেও তার অধিকাংশ যদি সচল না হয় প্রজনন ক্ষমতায় সমস্যা হতে পারে। আবার প্রতি মিলিলিটারে ২০ মিলিয়ন বা তার কম শুক্রাণু থাকার পরেও যদি গতিশীলতা ভাল থাকে অর্থাৎ ৬০ শতাংশেরও বেশি শুক্রাণুর সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ভাল থাকে, তখন সন্তানলাভে সমস্যা হয় না।
- শুক্রাণুর আকার- হু-র মাপকাঠিতে মোট শুক্রাণুর ৪ শতাংশের বেশি স্বাভাবিক আকারযুক্ত হলে সমস্যা নেই ধরে নেওয়া হয়। এখন আকারের এই পরিমাপ করাটা বেশ জটিল। কারণ একটি শুক্রাণুর মোটামুটি তিনটি অংশ থাকে —মাথা, মধ্যভাগ ও লেজ। কোনও শুক্রাণুর মাথা, কারও আবার হয়তো লেজে সমস্যা। তাই এই তিনটে অংশের গড়ে দু’ভাবে আকারের স্বাভাবিকত্বের পরিমাপ হয়- টেরাটোজুস্পার্মিয়া ইনডেক্স এবং স্পার্ম ডিফর্মিটি ইনডেক্স।
- বীর্যের পরিমাণ- মোটামুটি ভাবে বলা হয় বীর্যের পরিমাণ ২-৫ এমএল স্বাভাবিক। হু-র রেফারেন্স লিমিট ১.৪ এমএল। বীর্যের পরিমাণ কম থাকলে বলে হাইপোস্পার্মিয়া। সেমিনাল ভেসিকেলে ব্লকেজ থাকলে বা কোনও কারণে সেমিনাল ভেসিকেল অনুপস্থিত থাকলে এটা হয়। এইচআইভি-র মতো রোগ থাকলে বীর্যক্ষরণ কম হয়। নমুনা সংগ্রহের আগে জল বা তরলজাতীয় খাবার বেশি খেলে বেশি পরিমাণে বীর্য পাওয়া যায়। যৌন উত্তেজনা বেশি হলে বীর্যপাত বেশি হয়। বীর্যক্ষরণ আগে দু-তিন দিন বন্ধ রাখলে বেশি বীর্য পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল, বীর্য ৬ এমএল-এর বেশি হলে সেটাকে হাইপারস্পার্মিয়া বলে। প্রস্টেটে সমস্যা থাকলে এটা হতে পারে।
- ফ্রুক্টোজ- শুক্রাণুর গতিশীলতা আর প্রাণশক্তি পরিমাপের জন্য ফ্রুক্টোজ লেভেল বিশ্লেষণের দরকার হয়।
- বীর্যের পিএইচ- পিএইচ-এর মাত্রা ৭.২-৭.৮ এর মধ্যে থাকলে তা স্বাভাবিক। পিএইচ ৮ এর বেশি থাকার অর্থ ইনফেকশন হয়েছে। আর ৭ এর কম হলে বুঝতে হবে নমুনাটি কোনও কারণে নষ্ট হয়েছে অথবা সেমিনাল ভেসিকেলে ব্লকেজ রয়েছে।
- বীর্যের তারল্য- বীর্যরস প্রথমে ঘন থাকলেও পরে সেটি জলের মতো তরলে পরিণত না হলে শুক্রাণু এগোতে পারে না। ৩০-৬০ মিনিটের মধ্যে বীর্য তরলে পরিণত না হলে সমস্যা আছে ধরে নেওয়া হয়।
- বীর্যের রং- স্বাভাবিক বীর্য সাদা থেকে হালকা ধূসর রঙের ও অস্পষ্ট। বয়স বাড়লে হালকা হলদে ভাব আসে। বীর্যের রং লালচে বা হালকা বাদামি হওয়ার অর্থ রক্ত মিশেছে। কিছু ওষুধের প্রভাবে বীর্যের রং গাঢ় হলুদ বা সবজে হয়।
প্রাথমিক এই সব মাপকাঠিতে বীর্যরসে কোনও অস্বাভাবিকত্ব চোখে পড়লে আরও কিছু পরীক্ষা করতে দেন চিকিৎসকেরা। যেমন উচ্চ তরঙ্গ আলট্রাসাউন্ড প্রবাহের সাহায্যে শুক্রাশয় ও সংযুক্ত গঠন খতিয়ে দেখা হয়। পিটুইটারি গ্রন্থি ও শুক্রাশয় নিঃসৃত কিছু হরমোনের মাত্রা জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়। শুক্রাণু মূত্রথলিতে চলে যাচ্ছে কিনা বোঝার জন্য পোস্ট-ইজাকুলেশন ইউরিন্যালাইসিস করা হয়। জিনগত সমস্যা নির্ধারণের জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে শুক্রাশয়ের বায়োপ্সি করেও দেখা হয় শুক্রাণুর সংখ্যা ঠিক আছে কি না। প্রস্টেটে কোনও সমস্যা রয়েছে কিনা বা শুক্রবাহী নালীতে কোনও ব্লকেজ আছে কি না জানতে ‘ট্রান্সরেকটাল আলট্রাসাউন্ড’ করা হয় অনেক সময়।
মনে রাখতে হবে, মাত্র একবার বীর্য পরীক্ষায় যথার্থ ফল পাওয়া যায় না। আরও দু’বার পরীক্ষা করে সবের একটা গড় ধরে হিসাব করলে ভাল। কম করে দুই থেকে চার সপ্তাহের যেন ব্যবধান থাকে দু’টো পরীক্ষার মাঝে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছ, বীর্য বিশ্লেষণের প্রথম বারে গুণগত মান তুলনায় খারাপই আসে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
কীভাবে সিমেন্স বিশ্লেষণ পরীক্ষা সঞ্চালন করা হয়?
বীর্য বিশ্লেষণ পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
- নমুনা সংগ্রহ: নমুনা সাধারণত একটি ব্যক্তিগত সেটিংয়ে একটি জীবাণুমুক্ত পাত্রে হস্তমৈথুনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। বিকল্প পদ্ধতি, যেমন মিলনের সময় ব্যবহৃত বিশেষ কনডম, প্রয়োজন হলে উপলব্ধ হতে পারে।
- পরীক্ষাগার বিশ্লেষণ: বিভিন্ন শুক্রাণুর পরামিতি মূল্যায়ন করার জন্য নমুনাটি একটি মাইক্রোস্কোপের অধীনে বিশ্লেষণ করা হয়।
- অতিরিক্ত পরীক্ষা: কিছু ক্ষেত্রে, আরও বিশদ মূল্যায়নের জন্য আরও পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
বীর্য পরীক্ষার খরচ কত?
বীর্য বিশ্লেষণ পরীক্ষার গড় খরচ ৩০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। তবে, বিভিন্ন পরামিতি অনুসারে বীর্য বিশ্লেষণ পরীক্ষার খরচ পরিবর্তিত হয়। খরচ স্থানভেদে এবং ক্লিনিকের মান অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে।
কেন সিমেন্স পরীক্ষা করা হয়?
এটি উর্বরতার সমস্যা মূল্যায়ন, শুক্রাণুর সংখ্যা, গতিশীলতা (চলাচল), রূপবিদ্যা (আকৃতি) এবং সামগ্রিক শুক্রাণুর স্বাস্থ্যের মূল্যায়ন করা হয়।
একটি ভাল শুক্রাণু নমুনা কী?
প্রতি মিলিলিটারে ১৫ মিলিয়নের বেশি শুক্রাণু থাকা, ৪০% এর বেশি শুক্রাণু জীবিত এবং চলমান থাকা, এবং শুক্রাণুর আকৃতি স্বাভাবিক হওয়া—এইগুলি ভাল শুক্রাণু নমুনার বৈশিষ্ট্য।
হস্তমৈথুন কি শুক্রাণুর সংখ্যা কমায়?
শুক্রাণু উৎপাদন বয়স, জীবনধারা এবং প্রজনন ব্যবস্থার সামগ্রিক সুস্থতা সহ অনেক কারণের সাথে আপেক্ষিক। বীর্যপাতের পরে, পুরুষের শরীর তার শুক্রাণুর সরবরাহ পুরোপুরি পূরণ করে। এর অর্থ হস্তমৈথুন বা ঘন ঘন যৌন কার্যকলাপ শুক্রাণুর মাত্রা কমিয়ে দেয় না।
শুক্রাণু নমুনা দেওয়ার আগে আপনার কী করা উচিত নয়?
শুক্রাণু নমুনা দেওয়ার আগে, শুক্রাণুর সঠিক সংখ্যা এবং গুণমান পেতে ২-৫ দিনের জন্য বীর্যপাত থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া, অ্যালকোহল, কফি, এবং ক্যাফিন এড়িয়ে চলতে হবে।
Our Fertility Specialists
Related Blogs
To know more
Birla Fertility & IVF aims at transforming the future of fertility globally, through outstanding clinical outcomes, research, innovation and compassionate care.
Had an IVF Failure?
Talk to our fertility experts