শরীরের বাইরে প্রাণের সৃষ্টি আইভিএফ-এ
আইভিএফ-এর পুরো কথাটা হল, ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন। ভিট্রো কথার অর্থ শরীরের বাইরে। যে পদ্ধতিতে শরীরের বাইরে জীবন সৃষ্টি করা হয়, তাকে বলে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন। চলতি কথায়, টেস্টটিউব বেবি, নলজাতক শিশু।
প্রাকৃতিক বা জৈবিক উপায়ে যে সব দম্পতির সন্তান হচ্ছে না তাদের নিজস্ব ডিম্বাণু ও শুক্রাণু নিয়ে (পরিচিত বা অপরিচিত দাতার ডিম্বাণু, শুক্রাণুও হতে পারে) ল্যাবরেটরিতে ভ্রূণ তৈরি করার পর তা মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত করা হয় আইভিএফ পদ্ধতিতে। বিভিন্ন ধাপে বিভক্ত এই পদ্ধতিটি কিছুটা জটিল, ধকলযুক্ত, সময়সাপেক্ষ ও ব্যায়সাপেক্ষ হলেও এতে সন্তানলাভের সম্ভাবনা ৪০-৬০ শতাংশ। গত চার দশকে বিশ্বে প্রায় ৮০ লক্ষ শিশু আইভিএফ পদ্ধতিতে জন্মগ্রহণ করেছে। গবেষণায় বলছে, প্রাকৃতিক ও নলজাতক উপায়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে মেধাগত বা শারীরিক কোনও তফাত থাকে না। বরং এক্ষেত্রে সুবিধা হল, ভ্রূণের একটা পরীক্ষার মাধ্যমে আগেই জানা যায় শিশুর জটিল রোগ বা জিনগত ত্রুটি আছে কি না।
সন্তানলাভে অক্ষমতা ও সহায়ক গর্ভাধান
কোনও দম্পতি যদি এক বছর চেষ্টা করার পরও সন্তানধারণ না করতে পারে, সেক্ষেত্রে তারা সন্তানলাভে অক্ষম বলে ধরে নেওয়া হয়।
আধুনিক জীবনযাত্রায় সন্তানহীনতার সমস্যা বেড়েই চলছে। সমীক্ষা বলছে, প্রতি ১৪ জন মহিলার মধ্যে এক জনের সন্তানধারণে সমস্যা থাকে। এক্ষেত্রে বয়স একটা বড় ফ্যাক্টর। কারণ, যত বয়স বাড়ে ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণমান তত কমতে থাকে। এছাড়া মহিলাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জননতন্ত্রে নানা সমস্যা বাসা বাধে। যেমন, ফাইব্রয়েড, এন্ডোমেট্রিয়োসিস বা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম। আবার ডিম্বাশয়, ডিম্বনালী বা জরায়ুর সমস্যা, ডিম্বাণু নিঃসরণে অসুবিধা, এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রেও গর্ভধারণে অসুবিধা হয়। শুধু মহিলাদের নয়, সমস্যা থাকতে পারে পুরুষসঙ্গীরও। নির্দিষ্ট পরিমাণে সুস্থ স্বাভাবিক ও গতিশীল শুক্রাণুর অভাবে সন্তান হতে অসুবিধা হয়।
প্রাকৃতিক বা জৈবিক উপায়ে যাঁরা সন্তানধারণ করতে পারছেন না, তাঁদের জন্য আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অ্যাসিস্টেড কনসেপশন বা সহায়ক গর্ভাধান পদ্ধতির বিকল্প বন্দোবস্ত রয়েছে। তবে, প্রথমেই এই পদ্ধতির সাহায্য না নিয়ে ওষুধ বা ইনঞ্জেকশন দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন ডাক্তারেরা। এন্ডোমেট্রিয়োসিস, পলিসিস্টিক ওভারি বা ওভারিতে সিস্ট, ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লক থাকলে অনেক সময়ে ল্যাপরোস্কোপি-হিস্টিরিয়োস্কোপি করা হয়। এতেও কাজ না হলে আইইউআই (ইন্ট্রাইউটেরাইন ইনসেমিনেশন) বা আইভিএফ-এর (ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) মতো সহায়ক গর্ভাধান পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়।
আইভিএফ কখন ও কেন?
১) মহিলাদের ডিম্বনালীতে (ফ্যালোপিয়ান টিউব) সমস্যা বা ব্লক থাকলে ডিমের নিষিক্ত হওয়ার পথে বা ভ্রূণের জরায়ুতে যাওয়ার পথে বাধা হয়। আইভিএফ পদ্ধতিতে এই দু’টি ধাপ শরীরের বাইরে সম্পন্ন হয় বলে সমস্যাটি এড়ানো যায়।
২) যেসব মহিলার ঋতুস্রাব অনিয়মিত, ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসে ডিম্বাণু আসে না, তাদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কার্যকরী।
৩) এন্ডোমেট্রিয়াসিসের সমস্যা থাকলে জরায়ু, ডিম্বাশয় ও ডিম্বনালীর স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। এক্ষেত্রে আইভিএফের সাহায্য নিলে সুফল মেলে।
৪) ৩০ বছরের বেশি বয়সী মহিলাদের জরায়ুতে ফাইব্রয়েডের(টিউমার) উপস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম প্রতিস্থাপনে সমস্যা হয়। আইভিএফ পদ্ধতির সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
৫) ডিম্বনালী কেটে বা আটকে সন্তানধারণের পথ বন্ধ করার পর কোনও কারণে আবার গর্ভধারণ করতে চাইলে আইভিএফ-এর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
৬) অনেক সময়ই পুরুষের শুক্রাণুর ঘনত্ব (কনসেনট্রেশন), সচলক্ষমতা (মবিলিটি) বা আকার-আয়তনে (মরফোলজি) সমস্যা থাকতে পারে। পুরুষসঙ্গীর শুক্রাণুর গুণগত মানে সমস্যা থাকলেও এই পদ্ধতির সাহায্যে সুফল পাওয়া যায়।
৭) পুরুষসঙ্গী সহবাসে অক্ষম হলে বা ঠিকমতো বীর্যক্ষরণ না হলে অন্য দাতার থেকে শুক্রাণু (ডোনার স্পার্ম) নিয়ে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে আইভিএফ কার্যকরী ধাপ।
৮) যে সব দম্পতির সন্তানহীনতার কারণ অজানা অর্থাৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেও অক্ষমতার সঠিক কারণ জানা যায়নি তাদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
৯) জিনগত ত্রুটির সমস্যা থাকলে আইভিএফে সুফল মেলে। কারণ এই পদ্ধতিতে ডিম নিষিক্তকরণের পরে একটি ছোট্ট পরীক্ষা করা হয় (প্রিইমপ্ল্যান্টেশন জেনেটিক টেস্টিং) যাতে জিনগত কোনও ত্রুটি রয়েছে কি না তা জানা যায়। যদিও সমস্ত ত্রুটি এই পরীক্ষাতে ধরা না-ও পড়তে পারে।
১০) প্রজনন সংরক্ষণেও আইভিএফের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। যেমন, ক্যানসারের চিকিৎসা প্রজননক্ষমতায় খারাপ প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরুর আগে ডিম বা শুক্রাণু সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা যায় বা অনেকসময় ভ্রূণও সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
১১) জরায়ুর সমস্যার কারণে সন্তানধারণে অক্ষম হলে আইভিএফ পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে দম্পতির নিজস্ব ভ্রূণ অন্য মহিলার গর্ভে প্রতিস্থাপিত (জেসটেশানাল ক্যারিয়ার) করা যায়।
আইভিএফ-এর প্রস্তুতি
আইভিএফ-এ যথেষ্ট শারীরিক ও মানসিক ধকল যায় দম্পতির উপর দিয়ে। তাই ইতিবাচক মনোভাব এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে না পারলে এই পদ্ধতির সুফল মেলে না। মানসিক উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তায় থাকলে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। প্রজননক্ষমতায় যা অন্যতম বড় বাধা। শারীরিক ভাবেও সুস্থ-সবল থাকতে হবে। নিয়মিত হাঁটাচলা, যোগব্যায়াম করলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে হবে। মদ্যপান বা ধূমপান করা চলবে না। রাতে ঠিক সময়ে ঘুমিয়ে পড়া এবং পর্যাপ্ত ঘুম একান্ত জরুরি। আইভিএফ শুরু করার আগে চিকিৎসক বেশ কিছু শারীরিক পরীক্ষা করে দেখে নেবেন অন্য কোনও জটিলতা রযেছে কিনা। সমস্যা থাকলে তার চিকিৎসা করতে হবে।
আইভিএফ পদ্ধতি
ডিম ফোটা, ডিম সংগ্রহ, শুক্রাণু সংগ্রহ, নিষিক্তকরণ এবং ভ্রূণ প্রতিস্থাপন —এই ধাপগুলিতে আইভিএফ সম্পন্ন হয়।
প্রথম ধাপে ইনজেকশন দিয়ে ভাল ডিম্বাণু তৈরির চেষ্টা করা হয়। যদি ওষুধ দিয়েও পর্যাপ্ত সংখ্যায় ডিম্বাণু তৈরি না করা যায় তখন দাতার ডিম্বাণু নিয়ে আইভিএফ করা হয়। অ্যান্টি মুলেরিয়ান হরমোন বা এএমএইচ পরীক্ষা ও অ্যান্ট্রাল ফলিকিউল কাউন্টের মাধ্যমে আজকাল চিকিৎসকেরা বলে দিতে পারেন, ডিম্বাশয় থেকে কী রকম ডিম্বাণু তৈরি হবে। ঋতুচক্রের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন থেকে ফলিকিউলার স্টাডির মাধ্যমে এই বিষয়টি তত্ত্বাবধান করা যায়।
ফলিকিউলার স্টাডির আর একটা উদ্দেশ্য হল কবে ডিম্বাণুগুলি শরীরের বাইরে বার করে আনা হবে তা নির্ণয় করা। সেই মতো দিন দেখে আর একটি ইনজেকশন দেওয়া হয় যা ডিম ফাটিয়ে ডিম্বাণুকে বাইরে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। এই ইনজেকশন দেওয়ার ৩২-৩৬ ঘণ্টার মধ্যে আলট্রা সোনোগ্রাফির সাহায্যে ডিম্বাণুগুলিকে বাইরে বার করে আনা হয়। মিনিট কুড়ির মধ্যে একাধিক ডিম্বাণু বাইরে বার করে আনা যায়। এই সময় তলপেটে সামান্য চাপ অনুভব বা ব্যাথা হতে পারে।
একই দিনে পুরুষসঙ্গীর শুক্রাণু সংগ্রহ করে (ডোনার স্পার্মও ব্যবহার হতে পারে) পরীক্ষাগারে রেখে দেওয়া হয়।
এরপর ডিম্বাণু ও শুক্রাণু পরস্পরকে নিষিক্ত করে ভ্রূণ তৈরি হয় চিরাচরিত পদ্ধতিতে। অথবা শুক্রাণুকে সরাসরি ডিম্বাণুতে ইঞ্জেক্ট করে ভ্রূণ তৈরি করা হয় (আইসিএসআই)।
ভ্রূণ তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে তা ইনকিউবেটরে রাখা হয়। ডিম্বাণু সংগ্রহের পাঁচ থেকে ছ’দিনের মাথায় আট কোষ, ষোলো কোষ বা ব্লাস্টোসিস্ট অবস্থায় ভ্রূণ মায়ের গর্ভে প্রতিস্থাপিত করা হয় ক্যাথিটারের সাহায্যে। অনেক সময় দু’টি বা তিনটি ভ্রূণ প্রতিস্থাপিত করা হয়। এতে একদিকে যেমন গর্ভধারণে সফলতার হার বাড়ে, অন্যদিকে তেমনই যমজ বা তিনটি সন্তান প্রসবের সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই এই বিষয়টি নিয়ে আগেই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে রাখা ভাল যে ক’টি ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা হবে। বাড়তি ভ্রূণ সংরক্ষণ করে রাখা যায় ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য। এতে পরবর্তী কালে আবার আইভিএফ প্রক্রিয়ার সাহায্য নিতে হলে বেশ কয়েকটা ধাপ এড়ানো যায়, ঝামেলা কমে। চাইলে অব্যবহৃত ভ্রূণ অন্য দম্পতিকে দানও করা যায় বা গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেওয়া যায়।
আইভিএফ শেষে
আইভিএফ পদ্ধতি সামান্য অস্বস্তিকর হলেও যন্ত্রণাদায়ক নয়। ওষুধ দেওয়ার কারণে ডিম্বাশয় বড় হয়ে যায়, শরীরে জল জমে একটু ভারী লাগে এবং খিঁচুনি হতে পারে। তলপেটে সামান্য ব্যাথা হতে পারে। তবে, এই সমস্ত উপসর্গই কয়েক দিন পরে ঠিক হয়ে যায়।
এরপর জরায়ু যাতে ভ্রূণটি ধরে রাখতে পারে, তার জন্য কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। দু’সপ্তাহ পরে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় গর্ভধারণ সফল হয়েছে কি না। ‘পজিটিভ’ হলে চিকিৎসকেরা প্রসূতি বিশেষজ্ঞের কাছে ‘রেফার’ করেন। আর রেজাল্ট ‘নেগেটিভ’ হলে প্রোজেস্টেরন নেওয়া বন্ধ করে দিতে হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে ঋতুস্রাব শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। তা না হলে বা অস্বাভাবিক রক্তপাত হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নমালা:
১) কতবার আইভিএফ-এর চেষ্টা করা যায়?
গবেষণা বলছে, আইভিএফ পদ্ধতিতে পাঁচ থেকে ছয় বার চেষ্টার পরে সন্তানলাভের হার সবচেয়ে বেশি। কতবার চেষ্টা করা হবে, তার কোনও নির্দিষ্ট সীমা নেই। এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষ ও চিকিৎসকের উপর।
২) আইভিএফ-এ কি ওজন বাড়ে?
আইভিএফ চলাকালীন সামান্য ওজন বাড়া অস্বাভাবিক নয়। হরমোন ইনজেকশনের জন্য ওজন বাড়ার পাশাপাশি খিদেও বাড়ে।
৩) আইভিএফ-এ কী কী ঝুঁকি থাকে?
একাধিক সন্তান প্রসব ছাড়াও প্রিম্যাচিওর ডেলিভারি ও কম ওজনের সন্তান জন্মানোর সম্ভাবনা থাকে আইভিএফ পদ্ধতিতে। এইচসিজি হরমোন প্রয়োগের ফলে ওভারিয়ান হাইপারস্টিমুলেশন সিনড্রোমে ডিম্বাশয়ে ফোলা ভাব ও অল্প ব্যাথা হয়। স্বাভাবিক প্রসবের উপসর্গ যেমন মাথা ব্যাথা, বমি, দুর্বলতা থাকতে পারে। তবে, এগুলো কোনওটাই দীর্ঘমেয়াদী বা শরীরের পক্ষে খুব ক্ষতিকর নয়। বিরল হলেও ওভারিয়ান হাইপারস্টিমুলেশন সিনড্রোমের জেরে দ্রুত ওজনবৃদ্ধি ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা হতে পারে। আগে একটা ধারণা ছিল যে ডিম ফোটানোর জন্য যে ওষুধগুলো প্রয়োগ করা হয় তাতে স্ত্রী জননঅঙ্গে ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়ে পরবর্তীকালে। যদিও সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এই ধারণাটি সর্বৈব ভূল।